খলিলুর রহমান স্টালিন ও রফিকুল ইসলাম কামাল: দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তর জনপদ সিলেট নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভাস্বর। স্বকীয়তায় এখানকার মানুষ উদ্ভাসিত। সিলেটের মানুষের চাল-চলন, আতিথেয়তা, সংস্কৃতি, স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে সুদূর বিদেশেও বিস্তৃত। অতিথি আপ্যায়নে সিলেটের মানুষের রয়েছে দারুণ সুখ্যাতি।
তেমনি অতিথি হিসেবে কারও বাড়িতে যাবার সময় নানান কিসিমের মৌসুমী ফল-ফলাদি, মিষ্টি-মিঠাই বা পছন্দমত যে কোন জিনিস সঙ্গে করে নেওয়ার রেওয়াজও এখানে অনেক পুরনো। বিশেষ করে সিলেটের একান্ত আপন ঐতিহ্য হচ্ছে রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতারি নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ। সিলেটি ভাষায় যেটাকে বলা হয় ‘ফুরির বাড়ি ইফতারি’।
সিলেটের বেশ কয়েকজন প্রবীণ ও বয়স্ক ব্যক্তির সাথে আলাপ করে জানা গেল, রমজান মাসে জামাই বাড়িতে (মেয়ের শ্বশুরবাড়ি) ইফতারি দেওয়া সিলেটের বহুল প্রচলিত ঐতিহ্য। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে ইফতারি দেয়ার রীতি আবহমানকাল ধরে চলে আসছে এখানে।
তারা জানান, সিলেট অঞ্চলে নতুন জামাই বাড়িতে (মেয়ের শ্বশুরবাড়ি) তিন দফায় ‘ইফতারি’ দেয়া হয়। প্রথম দফায় ইফতারি প্রথম রমজানে দিতে হয়। ওই দিন শুধু ঘরে তৈরী করা পিঠা-পায়েসসহ ফল-ফলাদি নিয়ে জামাই বাড়িতে যাওয়া হয়।
ইফতারি আইটেমের মধ্যে রয়েছে- সন্দেশ, ছই পিঠা, চিতল পিঠা, রুটি পিঠা, ভাপা পিঠা, ঢুপি পিঠা, খুদি পিঠা, ঝুরি পিঠা, পানি পিঠা, চুংগা পিঠা, তালের পিঠা, পাড়া পিঠা, নুনের ডোবা, নুনগরা এবং নারিকেল সমেত তৈরি পবসহ আরো নানা ধরনের পিঠা। এছাড়াও খেজুর, আপেল, আম তো থাকেই।
দ্বিতীয় দফার ইফতারি ১০ থেকে ২০ রমজানের মধ্যে দেয়া হয়। এ দফায় ইফতার সামগ্রীর মেন্যুতে মিষ্টি, জিলাপী, নিমকী, খাজা, আমির্তি, বাখরখানি ছাড়াও মৌসুমী ও দেশী বিদেশী ফল-ফলাদি, চানা, পিঁয়াজু, পোলাও, চপ, বেগুনী ও শাকের তৈরী বিভিন্ন ধরনের বড়া ইত্যাদি দিয়ে সাজানো খাঞ্চা (বড় থাল) নেয়া হয়। আবার কোথাও মেয়ের জামাই, মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি, মেয়ের জা’দের জন্য আলাদা করে থাল সাজিয়ে নিয়ে যেতে হয়। সাধারণত নতুন আত্মীয়তা হলে সাজানো থাল বা খাঞ্চা নেয়া হয়।
ইফতারি দেয়ার সর্বশেষ দফা হলো রমজানের শেষ সপ্তাহ। ওই সময় মেয়ের জামাইর পরিবারের জন্য ঈদের কাপড়সহ ঈদ কার্ড নিয়ে যেতে হয়। আর সাথে থাকে হালকা ইফতারি। এ দফায় জামাই বাড়িতে ইফতারি নিয়ে গর্ব সহকারে যান কনের দাদা-নানা, বাবা-চাচা, ভাই অথবা নিকট আত্মীয় যে কেউ। এ সময় মেয়ের জামাই’র বাড়ির সকলকে ঈদে বেড়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে আসা হয়।
এদিকে, মেয়ের বাড়ি থেকে যে ইফতারি নিয়ে যাওয়া হয় সেই ইফতারি মেয়ের জামাই’র ইফতারের পূর্বেই বাড়ির এবং পাড়া-পড়শীর প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিলি করা হয়। ইফতারের পরে মেজবানের ভূরিভোজের জন্য আগেভাগেই জবাই করা হয় ঘরে পোষা বড় মোরগ বা মুরগী। থাকে সালাদ, দইসহ বিভিন্ন আইটেম।
প্রবীণদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, আগেকার দিনে ফার্মের মুরগী পাওয়া যেত না। নিজের ঘরে পোষা মুরগী না থাকলে বা ধরতে ব্যর্থ হলে পার্শ্ববর্তী কোন ঘর থেকে মুরগী কিনে বা ধার করে আনা হতো ‘মান-ইজ্জত রক্ষার’ জন্য। মুরগী ধরার জন্য বাড়ির চটপটে কিশোর-কিশোরীদের কাজে লাগানো হতো। ব্যর্থ হলে জাখার (খাচা) নিচে খাদ্য সামগ্রী দিয়ে মুরগিকে ‘লোভ’ দেখিয়ে আটকানো হতো। মেহমান যাতে মুরগীর কক্ কক্ শব্দ শুনতে না পান সেজন্য মুরগীর গলা চেপে ধরা হতো সতর্কতার সাথে ও তড়িগড়ি করে জবাই করা হতো মুরগি।
প্রবীণরা জানান, মেহমান দেখতে পেলে মোরগ-মুরগী জবাই না করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করতেন। আবার কোন কোন মেহমান মুরগী খাবার লোভে দেখেও না দেখার ভান করতেন! একান্ত কোথাও মুরগী না পেলে বা ব্যর্থ হলে এন্ডা (ডিম) এনে ভুনা বা ভাজি করা হতো। মাছ দিয়ে মেহমানদেরকে খাওয়ালে বদনাম হতো বলে প্রবীণরা জানান। সেই আগেকার দিনের রেওয়াজ এখনো স্বমহিমায় সিলেটে ঠিকে আছে। এখনো ইফতারি নিয়ে বাড়িতে মেহমান এলে ঘরের মোরগ-মুরগী জবাই করা হয়। মাছ দিয়ে মেহমানদের আপ্যায়ন করানোকে এখনো সম্মানহানিকর ভাবা হয়।
এদিকে বিয়েতে যিনি ‘উকিল পিতা’ হন, তার পক্ষ থেকেও ইফতারি দেয়ার ব্যাপক প্রচলন সিলেটে দেখা যায়। অনেকে ইফতারী দেয়ার পূর্বে কৌশলে খবর নেন অন্য বেয়াইর (মেয়ের প্রকৃত পিতা) বাড়ি থেকে কোন ধরনের বা কি পরিমাণ ইফতারি এসেছে। আবার স্বামী বা শ্বশুর-শ্বাশুরী ‘জল্লাদ’ বা ‘খিটখিটে মেজাজে’র হলে নয়া বউ ফোন করে গোপনে বাপের বাড়িতে সংবাদ প্রেরণ করেন ‘আর কিছু না হোক ইফতার সামগ্রী উন্নত ও পরিমাণে যেন বেশি হয়।’ কোন কোন বদ মেজাজী পেটুক বা লোভী বর কিংবা বরের পিতাকে ইফতার সামগ্রী একটু কম বা কিছুটা নিম্নমানের হলে রাগ গোস্বা করতেও দেখা যায়।
সিলেট মহানগরীর জিন্দাবাজার থেকে ইফতারি কিনছিলেন আবদুল আউয়াল নামক এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। কথা হয় তার সাথে। মেয়ের বাড়িতে দিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল আউয়াল বললেন, ‘ফুরির বাড়ি ইফতারি না দিলে ওইবো না কিতা? দিলাইছি একআরা। আরো দুইআরা দিমু।’ তার কথার মর্মার্থ হচ্ছে- ‘মেয়ের বাড়ি ইফতারি না দিলে কি চলে? এক দফা দিয়েছি। আরো দুই দফা দেব।’
আধুনিকতার এই যুগেও অনেকে নতুন আত্মীয়ের বাড়ির ইফতার খাবার জন্য সুদূর প্রবাস থেকেও দেশে আসেন। আবার অনেকের মেয়ে জামাইয়ের সাথে বিদেশে থাকলেও লোক মারফত জামাইর দেশের বাড়িতে ইফতারির জন্য টাকা প্রেরণ অথবা ইফতারি প্রদান করতে শুনা যায়। সময়মতো ইফতারি দিতে না পারলে কোথাও কোথাও হালকা ঝগড়া-ঝাঁটি বা মনোমালিন্যও হয়।