শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: বিগত বছরে দৃশ্যত ক্রেমলিনের এই নেতা বহির্বিশ্বে রাশিয়ার ভাবমূর্তি উন্নত করেছেন। ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের বন্ধুতে পরিণত করেছেন। শক্তিশালী বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে পুতিন ২০১৭ সালে প্রবেশ করলেন। বিগত বছরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে একপেশে করে সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি করিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসা পেয়েছেন।
নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বক্তব্য রাখলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৬ সালে দুর্দান্ত সফলতার পর শনিবার তিনি তার দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে অবরোধ দিয়েছেন, ৩৫ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছেন তার কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে মহৎ এক ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
জাতির উদ্দেশে দেয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, আমরা কাজ করছি। কাজ করছি সফলতার সঙ্গে। আমরা এক্ষেত্রে অর্জনও করেছি অনেক বেশি। আমরা যে বিজয় ও অর্জন এনেছি তার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। এজন্য আপনারা আমাদের বুঝতে পেরেছেন। আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। রাশিয়ার প্রতি আপনাদের আন্তরিকতার জন্য এটা সম্ভব হয়েছে।
রাশিয়ার ভিতরে পুতিন ভীষণ জনপ্রিয়। সিরিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার শীর্ষ স্থানীয় ভূমিকার জন্য বহির্বিশ্বে পুতিনের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমা জগতে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এমন দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে।
পুতিন এমন একটি ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছেন যে, হ্যাকিং ও রাজনৈতিক কৌশলে তিনি নির্বাচনের ফল পাল্টে দিতে পারেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন তার দাপট বাড়িয়েছিল তখন এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয় যে, মস্কো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
এর মধ্য দিয়ে তারা নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। এ থেকেই সৃষ্টি হয় শীতল যুদ্ধের ফ্যান্টাসি। আর এখন সিআইএ বলছে হ্যাঁ রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। এটাকে গত ১২ মাসে পুতিনের বড় বিজয় বলে দেখা হচ্ছে।
এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝাতে চাইছেন, ক্রেমলিনকে কেউ থামাতে পারবে না।
তবে কি এর মধ্য দিয়ে পুতিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন! তিনি কি বিশ্ব সভায় নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সমান বা তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন! হয়তো অথবা হয়তো নয়।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে রাশিয়া এখন আর সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। আর যে লড়াই চলছে বাইরের দেশের সঙ্গে সেটাও কোনো শীতল যুদ্ধ নয়। দৃশ্যত মস্কোও বিশ্বে মাতব্বরি দেখাতে চাইছে বলে মনে হয় না। ভ্লাদিমির পুতিনের এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সীমিত।
তিনি চাইছেন রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে খর্ব করতে। তার যে ক্ষমতা প্রয়োজন তা এখনও দুর্বল অর্থনীতির কারণে অনেকটাই সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ে যাওয়ার জন্য এক্ষেত্রে তার ঘাটতি রয়েছে। পুতিন যা চান তা তিনি চাইলেই করতে পারছেন না।
তিনি একা একা তা করতে পারেন না। অনেকাংশে তা নির্ভর করে পরিস্থিতি ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ওপর। ট্রাম্প তার সঙ্গে কেমন আচরণ করেন ভবিষ্যতে, দু’দেশের সম্পর্ক কোন মানদণ্ডে দাঁড় করান তা এক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি দৃশ্যত পুতিনের বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তি রেক্স টিলারসনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছেন।
পুতিনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ দিলে ও ৩৫ কূটনীতিককে বহিষ্কার করার পর উল্টো সুরে কথা বলেছেন ট্রাম্প। এ থেকে ধরে নেয়া যায় ক্রেমলিনের সঙ্গে ওয়াশিংটন একটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
কার্নেজ মস্কো সেন্টারের সিনিয়র এসোসিয়েট আন্দ্রেই কোলেসনিকভ বলেছেন, বিঘ্ন সৃষ্টিকারী পশ্চিমাদের সামান্য সহায়তা নিয়ে বিশ্বকে শাসনের নতুন নীতি তৈরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পুতিন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়া অনেকটা দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর।
তিন বছর আগে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া নিয়ে লড়াই শুরু করেন পুতিন। তখনকার চেয়ে রাশিয়া এখন অনেক বেশি দরিদ্র। মস্কো টাইমসে প্রকাশিত এক তথ্যমতে, ২০১৩ সালে রাশিয়ার জাতীয় প্রবৃদ্ধি ছিল ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার। তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
এ সংখ্যা ইতালি, ব্রাজিল ও কানাডার চেয়ে কম। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমওর তথ্যমতে সেখানে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৯ হাজার ডলারের নিচে। এখনও রাশিয়া খুব বেশি নির্ভরশীল তার প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানির ওপর। অর্থনীতির সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণ থেমে আছে।
অনলাইন গেজেটের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে রাশিয়ানদের সঞ্চয় ছিল শতকরা ৭২ ভাগ। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২৭ ভাগ। সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো রাশিয়ানরা তাদের খরচের অর্ধেকেরও বেশি ব্যয় করছেন মুদিপণ্য কিনতে। একো মস্কোভি রেডিও টক শোয়ের উপস্থাপক অ্যালেক্সি গুসারোভের পর্যবেক্ষণ বলছে, রাশিয়াকে পুতিন দেখছেন একরকম। কিন্তু বহু রাশিয়ান রাশিয়াকে দেখছেন অন্যভাবে। দু’ভাবনা কখনো একটির সঙ্গে আরেকটি মেলে না।
রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী বেশির ভাগ ক্ষমতার মালিক প্রেসিডেন্ট। ফলে দেশটির শক্তি কোনদিকে ব্যয় হচ্ছে তার পুরোটাই নির্ভর করে পুতিনের ওপর। মস্কোভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভ্লাদিমির ফ্রোলভ বলেছেন, রাশিয়ায় কোনো একজন মানুষ যদি ভাবতে চান রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থ কি এবং কি নয় তাহলে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নেই যিনি এর সারমর্ম করতে পারেন।
আগামী বছর রাশিয়ায় নির্বাচন। সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে পুতিন বিজয়ী হবেন বলেই মনে হয়। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ যখন থমকে দাঁড়িয়েছিল তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। এজন্য তার সফলতা বা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলে রাশিয়া তার সুযোগ ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে। রাজনৈতিকবোদ্ধারা বলছেন, সোভিয়েত নেতারা যেকোনো স্থানে, যেকোনো অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে টক্কর দেয়ার কথা বলছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে পুতিনের রয়েছে সীমাবদ্ধতা। ডনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র বৃদ্ধির কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, যেকোনো আগ্রাসন কাটিয়ে উঠতে রাশিয়া তার পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিকায়ন করছে। তবে রাশিয়া কোনো অস্ত্র প্রতিযোগিতায় যেতে চায় না। তাদের সেই সক্ষমতা নেই। খুব বেশি আগের কথা নয়। তখন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা এমন ধারণা দিচ্ছিলেন, কিউবা ও ভিয়েতনামে সোভিয়েত যুগের ঘাঁটিগুলো পুনঃস্থাপন করতে হবে। কিন্তু তা ঘটেনি। নতুন বছরে পুতিন তার ক্ষমতার উচ্চ শিখরে থাকবেন এমনটাই মনে হচ্ছে।