শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভিবাসীসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়ে ইতোমধ্যেই দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন।
এমনই এক সময় তার সঙ্গে রাণী এলিজাবেথের সাক্ষাত্ দেওয়া ঠিক হবে না কী না, এ নিয়ে প্রশ্ন এখন অনেকের।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এখনো মান মর্যাদা পুরোপুরি হারিয়ে বসেনি। এই রাজতন্ত্র দেশটির অন্যতম শক্তিশালী কূটনৈতিক হাতিয়ারও বটে। বিশ্ব রাজনীতিতে দেশটির যে এখনো একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আছে তার অন্যতম নিয়ামক হাজার বছরের পুরনো রাজতন্ত্র।
রাণী শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে একজন রাজন্যই নন, পদাধিকার বলে তিনি ডিফেন্ডার অব ফেইথ বা চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধানও বটে। সব মিলিয়ে ব্রিটিশ সমাজে তিনি এক অনন্য মর্যাদার অধিকারকারিণী।
ব্রিটিশ সরকার যখন কোনো রাষ্ট্র প্রধান সেদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানায় তখন সেটি রাণীর পক্ষ থেকেই করা হয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মেও তাই করেছেন। প্রশ্ন হলো ট্রাম্পকে সাক্ষাত্ দিলে রাণীর নিজের বা ব্রিটিশ রাজপরিবার বিতর্কে মুখে পড়তে পারে কি না।
বিশেষ করে ট্রাম্পের ব্রিটেন সফর নিয়ে খোদ ব্রিটেনেই যেখানে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অবস্থা এতদূর গড়িয়েছে যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে এ নিয়ে বিতর্ক করতে হয়েছে। বিষয়টি ব্রিটেনের রাজনীতিতে এমন বিতর্কের ঝড় তুলেছে যে সরকার শেষ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় যে ট্রাম্প ব্রিটেনে আসবেন ঠিকই তবে পার্লামেন্টে বক্তৃতা করবেন না।
এজন্য ট্রাম্পের সফরসূচি নতুন করে নির্ধারণ করে আগস্টে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। শরতকালীন ছুটির জন্য পার্লামেন্ট তথন বন্ধ থাকবে। তাই সেখানে ভাষণ দিতে হবে না ট্রাম্পকে। এভাবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের সরকারেরই বিকল্প উপায়ে মুখ রক্ষা হবে।
রাণীর বয়স হয়েছে। গত বছর তিনি ৯০ পুরো করেছেন। ৬৪ বছর ধরে তিনি সিংহাসনে আছেন। ১১৬টি দেশে ২৬৫ বার অফিসিয়াল ভিজিট করার সুযোগ তার হয়েছে।
তার সাক্ষাৎ পাওয়া যে কোনো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। অভিবাসীসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশে-বিদেশে যখন ট্রাম্পের ভাবমূর্তি সংকটে এ অবস্থায় হার ম্যাজেস্টি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাক্ষাত্ কূটনৈতিকভাবে তার মুখ রক্ষা করবে সেটি জোর দিয়েই বলা যায়।
ব্রিটেনে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত সফরের বিরুদ্ধে অনলাইনে ১৮ লাখ মানুষ নিজেদের গররাজির কথা জানিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, তিনি ব্রিটেনে আসুন অসুবিধা নেই রাণীর সঙ্গে দেখা না করলেই হলো।
সম্প্রতি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে অনুষ্ঠিত একটি বিক্ষোভ সমাবেশে বহন করা প্লাকার্ডে লেখা ছিল ঈশ্বর ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারীর হাত থেকে রাণীকে রক্ষা করুন।
পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা পিটার রিকেঁস টাইমস অব লন্ডনের কাছে লেখা এক চিঠিতে প্রশ্ন রেখেছেন, ট্রাম্প আদতে এমন সম্মান পাওয়ার যোগ্য কি না?
তিনি আরো লিখেছেন এ সফর রাণীকে উভয় সংকটের মুখোমুখি করবে। রাজতন্ত্রের সঙ্গে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন, যারা রাণীর সম্মানের জন্য রাজপথে প্রতিবাদ করছেন তারা হয়তো জানেন না তার এ ধরনের সুরক্ষার প্রয়োজন নেই। রাজ পরিবার ব্রিটেন রাষ্ট্রটির জন্য এমন এক সম্পদ যার মর্যাদা কোন ঠুনকো বিষয় নয়।
এক্ষেত্রে রাণী এলিজাবেথের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বা কূটনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে রাজ পরিবার ব্রিটিশ সরকারের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করলেই তা ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রশ্ন আসে না।
রাণী ১৯৭৮ সালে রুমানিয়ার শাসক ও দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নিকোলা চসেস্কু’র সঙ্গে সাক্ষাত্ দিয়েছিলেন। নেতা হিসাবে তিনি ছিলেন নির্দয়। তার শাসনামলে দেশটির অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। পরিণতিতে গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন।
তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ওয়েন হিসেব কষেছিলেন যে, চসেস্কু’র সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করার মাধ্যমে বাকি কমিউনিস্ট ব্লকের সঙ্গে রুমানিয়ার সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি করা সম্ভব হতে পারে এবং বাস্তবে হয়েছিলও তাই।
১৯৯৪ সালে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে’কে ব্রিটেনের সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। উদ্দেশ্য ছিল দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা।
মুগাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের তাদের জমি থেকে উত্খাতের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে নিন্দিত ছিলেন। উত্তরাধিকারী সূত্রও রাণীকে কূটনৈতিক ভাবমূর্তি গড়তে কিছুটা সহায়তা করেছে। বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও তার বাবা পঞ্চম জর্জও ছিলেন এ কাজে বিশেষ পারদর্শী।
রাণী ইতোপূর্বে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পুতিন পরবর্তীতে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করেন। এমন কি ২০০২ সালে তিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে বাকিংহাম প্যালেসে সাক্ষাত্ দিয়েছিলেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি ওয়েস্টমিনস্টার হলে এ বিষয়ে বিতর্কে অংশ নিয়ে লেবার দলীয় এমপি পল ফ্লিন বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদটির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে। তাদের সংবিধান ও ইতিহাসকেও আমরা সম্মান করি। দেশটির প্রতি অশ্রদ্ধা জানানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু তা সত্ত্বে ট্রাম্পকে এ সময় স্বাগত জানানো যায়না বলে তিনি মন্তব্য করেন। সেটি করা হলে তার বালখিল্য আচরণ ও খামখেয়ালি পূর্ণ কাজের প্রতি ব্রিটিশ জনগণের সমর্থন আছে বলে ধরে নেওয়া হবে। কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকেই ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বছর যুক্তরাজ্য সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এদিক দিয়ে এটি ট্রাম্পের জন্য বিরল সম্মান বলতে হবে।
বারাক ওবামাকে হোয়াইট হাউসে ঢোকার ২৮ মাস, জর্জ ডব্লিউ বুশকে ৩২ মাস, বিল ক্লিনটনকে ৩৪ মাস ও রোনাল্ড রিগ্যানকে ১৮ মাস পরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল (সিনিয়র বুশ যুক্তরাজ্য সফর ও প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেও ব্রিটিশ সরকার কখনো তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমন্ত্রণ জানায়নি)।
যাই হোক, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও একক বাজার ছাড়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ অবস্থায় বাণিজ্যিক সহযোগী খোঁজার জন্য টেরেসা মে’র হাতে খুব বেশি সময় নেই।
তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ শুরু করেছেন তেমনি যোগাযোগ রাখছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সঙ্গেও। কারণ ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষার জন্য তার সামনে খুব বেশি বিকল্প নেই