ফাহমিদা উর্ণি: মৃত্যুর কয়েকমাস আগে নিজের রেকর্ডকৃত এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রিন্সেস ডায়না বিশ্বকে জানিয়ে দিয়ে যান, ব্যারি মান্নাকি নামের এক দেহরক্ষীই ছিলেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমিক।
১৯৮৭ সালে মান্নাকির সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সৌন্দর্য্য, মানবিকতা আর বিদ্রোহে সারা পৃথিবীতে আলোচিত ওই ব্রিটিশ রাজবধূ।
রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ জারি করে তিনি হত্যাকাণ্ডের জন্য পরোক্ষে রাজপরিবারকেই দায়ী করে গেছেন। তবে যার গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে মান্নাকি প্রাণ হারিয়েছিলেন, সম্প্রতি সেই গাড়িচালকের সন্ধান পায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট।
এটিকে হত্যাকাণ্ড বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সেই গাড়িচালক। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ইন্ডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, দুর্ঘটনার সময় যিনি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন, তিনি একজন অবসারপ্রাপ্ত চিকিৎসক।
১৯৮৭ সালের ১৪ মে বাইক থেকে পড়ে গিয়ে মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পাওয়ার পর মৃত্যু হয় মান্নাকির। একটি গাড়ির সঙ্গে বাইকের সংঘর্ষ হওয়ার উপক্রম হওয়ার কারণে তিনি বাইক থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। বাইকটি চালাচ্ছিলেন মান্নাকির সহকর্মী।
অপর পাশ থেকে বিউটি থেরাপিস্ট নিকোলা চপের চালানো গাড়ি সামনে এসে পড়লে সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা হয়। তার মৃত্যুর পর এক ষড়যন্ত্র তত্ত্বে দাবি করা হয়, ‘এক রহস্যময় চালক’ ১৭ বছর বয়সী ব্যারি মান্নাকির সুজুকি বাইকটি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন।
তাদের দাবি, ওই রহস্যময় গাড়িটিই ইচ্ছে করে বাম দিকে মোড় নেওয়ার সংকেত দিয়ে ওই গাড়িগুলোকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছিল। অভিযোগ করা হয়, দুর্ঘটনার পর গাড়িটি সেখানে থামেনি এবং আর কখনও দেখাও যায়নি।
ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের দাবি, মান্নাকিকে হত্যার কারণ হলো ডায়নার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। ওই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে দাবি করা হয়েছিল, মান্নাকির মৃত্যুর কারণ নিছক কোনও সড়ক দুর্ঘটনা ছিল না, তাকে পরিকল্পিতভাবে গাড়ি ধাক্কা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রিন্সেস ডায়নার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণে তাকে সিক্রেট সার্ভিসের (সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা) লোকেরা হত্যা করেছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছিল ওই তত্ত্বে।
ভয়েস কোচ পিটার সেটেলেনের রেকর্ড করা ডায়নার একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসিতে প্রকাশ হয় ২০০৪ সালে। মান্নাকির প্রসঙ্গে ডায়না
ওই ভিডিওতে বলেছিলেন: ‘আমার জীবনের সেরা প্রেম ছিল সে। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে থাকার জন্যও আমি রাজি ছিলাম। আর সেও এটাকে ভালো চিন্তা বলে মনে করতো। যখন এটা জানাজানি হলো তখন তাকে রাজকীয় সুরক্ষাব্যবস্থার আওতা থেকে বের করে দেওয়া হলো। তারপর তাকে হত্যা করা হলো। আমি মনে করি তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
চ্যানেল ফোরের সাম্প্রতিক ডকুমেন্টারি ডায়না: ইন হার ওন ওয়ার্ডস আবারও ব্রিটিশ রাজবধূর বলা কথাগুলোকে সামনে এনেছে। এটি প্রচারিত হওয়ার পরই মান্নাকির মৃত্যুকে ঘিরে ৩০ বছরের পুরনো সেই প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে।
তবে সেই রহস্যময় গাড়ির চালকের সন্ধান পাওয়ার দাবি করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট। সংবাদমাধ্যমটির দাবি, তারা ওই গাড়ি চালককে শনাক্ত করেছে এবং তিনি সংবাদমাধ্যমটিকে ওই ঘটনা এবং তার পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করেছেন।
ইন্ডিপেনডেন্ট জানায়, ওই চালক একজন অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক। তিনি ওই দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলতে নারাজ। এ অভিযোগকে হাস্যকর উল্লেখ করে নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।
ওই চিকিৎসকের দাবি, ঘটনার পর সেখানে থেমে গিয়েছিলেন তিনি এবং দুর্ঘটনাকবলিতদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে শুরু করেছিলেন। ওই চালক আরও জানান, তিনি কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা দিয়েছেন এবং ওই দুর্ঘটনা পরবর্তী কয়েকটি দিন পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন।
ইন্ডিপেনডেন্টকে তিনি বলেন: ‘ব্যারি মান্নাকিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করিনি আমি। এটা হাস্যকর…..চরম হাস্যকর অভিযোগ। বাজে কথা। সংবাদপত্রের বিক্রি বাড়াতে কেউ কেউ এমনটা করছে।’ ষড়যন্ত্র তত্ত্বটির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি নিজেকে ‘স্তম্ভিত’ বলে উল্লেখ করেন। ১৯৮৮ সালে বীমা কোম্পানির কাছে তার দেওয়া বক্তব্যের লিখিত প্রমাণও হাজির করেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন: ‘আমি ঘণ্টায় প্রায় ২০-২৫ মাইল বেগে গাড়ি চালিয়ে বামে মোড় নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম, আমি হারমিটেজ ওয়াক নামে যে সড়কে মোড় নিতে যাচ্ছি সেখান দিয়ে একটি গাড়ি যাচ্ছে। গাড়িটি ডান দিকে মোড় নিচ্ছিল। ট্রাফিক লাইট ছাড়ার পর পরই এবং বাস স্টপ আসার আগে একটি মোটর সাইকেল আমাকে অতিক্রম করলো। বাস স্টপটি হারমিটেজ ওয়াক ও ট্রাফিক লাইটের মাঝামাঝি অবস্থানে ছিল।
ওই গাড়িটি খুব স্বাভাবিক গতিতে পার হচ্ছিল। বলা চলে ঘণ্টায় ১০-১৫ মাইল বেগে যাচ্ছিল। গাড়িটিকে এড়ানোর জন্য মোটর বাইকটি রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তী যে দৃশ্য আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে তা অস্পষ্ট। আমার শুধু মনে আছে মোটর বাইকটি গতিপথ পাল্টাচ্ছে।’
ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা তাকে সিক্রেট সার্ভিসের সদস্য উল্লেখ করে যে দাবি করেছে তাও হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন ওই গাড়ি চালক। উল্টো তিনি দাবি করেছেন, সিক্রেট সার্ভিস তো দূরের কথা, অ্যাজমা থাকার কারণে ন্যাশনাল সার্ভিসেও কাজের সুযোগ পাননি। ১৯৯৭ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রিন্সেস ডায়না,তার বন্ধু দোদি ও গাড়িচালক হেনরি পল। ডায়নার মৃত্যুর পরও নানা রহস্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ বলছে,সড়ক দুর্ঘটনায় বন্ধু দোদি আল-ফাহাদসহ তার মৃত্যু হয়েছিল।
বিবিসি, গার্ডিয়ান, টেলিগ্রাফ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে আসা কিছু তথ্যের বরাত দিয়ে একে হত্যাকাণ্ড বলছিলো। দোদির বাবা মোহাম্মদ ফায়েদও চেষ্টা করেছিলেন ওই দুর্ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণের। তাছাড়া মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন ডায়ানা। তার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে কিনা এমন সংশয় পোষণ করেন অনেকে।