এমসি কলেজের হোস্টেলে আগুন দেয়া সেই ছাত্রলীগ কর্মীরাই কোর্ট পয়েন্টে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ওপর হামলা চালিয়েছে। খোদ দলের নেতাকর্মীরাই বলছেন, আগুনের ঘটনার বিচার হলে ছাত্রলীগের সেই কর্মীরা এ ঘটনা ঘটানোর মতো সাহস পেতো না। তবে কোর্ট পয়েন্টের ঘটনার পর আওয়ামী লীগের টনক নড়েছে।
ইতিমধ্যে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ও ৬৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আর গতকাল থেকে র্যাব ও পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে। বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই বেসামাল সিলেটের জেলা ছাত্রলীগ। তাদর কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তাদের কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে বহুবার বিতর্কিত দলের কার্যক্রম। বিব্রত হয়েছে মূল দল আওয়ামী লীগ।
কিন্তু বেসামাল ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েছে নেতারা। রেরাববার সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে সিপিবি ও বাসদের সমাবেশ ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুমতি দেয়া সমাবেশ। পূর্ব থেকে অনুমতি নিয়ে ওই সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। আর বিকেল ৩টা থেকে শুরু হওয়া সমাবেশে উপস্থিতি ছিলেন সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও বাসদের আহ্বায়ক কমরেড খালেকুজ্জামান। তাদের সমাবেশ স্থলের পাশ দিয়ে ছাত্রলীগের আনন্দ মিছিলটি যাওয়ার পর অতর্কিত হামলা চালায়। ওই আনন্দ মিছিলের নেতৃত্বে ছিল সিলেট জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিরন মাহমুদ নিপু।
হামলার ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা হামলার ঘটনায় প্রথমে কোন বাধা প্রদান করেনি। সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি আক্তার হোসেন কেবলমাত্র নিজে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওসি আক্তার হোসেনের নিষেধ মানেনি ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা। তারা মঞ্চে থাকা সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে মারধোর করে। একপর্যায়ে কমরেড খালেকুজ্জামানকেও মারধোর করে। হামলার ঘটনার পর ছাত্রলীগ কর্মীরা সিটি পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছিল।
এরপর পুলিশ ও র্যাব তাদের উপর অ্যাকশন শুরু করে। রাতে সংবাদ মাধ্যমের কাছে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিরন মাহমুদ নিপু জানিয়েছেন, ওই সমাবেশ থেকে সরকার বিরোধী মিছিল দেওয়ায় কিছু সংখ্যক কর্মী বিক্ষুব্ধ হয়ে হামলা করেছে। তবে তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সিলেটে ছাত্রলীগের ওই গ্রুপটি ২০১২ সালে এমসি কলেজের হোস্টেল জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন পংকজ পুরকায়স্থ। পরবর্তীতে এমসি কলেজের হোস্টেল জ্বালানোর ঘটনা এবং শিক্ষা প্রকৌশলীকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তাকে সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এমসি কলেজের হোস্টেল জ্বালানো সময় সাবেক সভাপতি পংকজ ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিরন মাহমুদ নিপুর মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল।
এমসির হোস্টেল জ্বালানোর ঘটনায় পংকজ, নিপু সহ ২০ জন ছাত্রলীগ নেতা অংশ নিয়েছিল বলেও এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষের তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ হয়েছিল। এছাড়া ওই সময় জেলা প্রশাসকের তদন্ত রিপোর্টেও একই ভাবে ছাত্রলীগকে দায়ী করা হয়েছিলো। কিন্তু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কিংবা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা দেশজুড়ে আলোড়িত এ ঘটনাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এদিকে, এ দুটি ঘটনার বাইরে সিলেটে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালিয়েছে যুবলীগের কর্মীরা। সিলেটের শহীদ মিনার জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার দিন নগরজুড়ে ব্যাপক অরাজকতা চালিয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মীরা। তারা প্রকাশ্য অস্ত্র হাতে সিলেটে দিয়েছে মহড়া। তাদের ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এবং লুটপাটের ঘটনায় আন্দোলনও শুরু করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া এমসি কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজির ঘটনার বেশ কয়েকবার সমালোচিত হয় ছাত্রলীগ। বর্তমান সরকারের সাড়ে ৪ বছরে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজে একাধিকবার ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে গুলি বিনিময় হয়েছে।
আর এসব গুলি বিনিময় ও অস্ত্রের মহড়ার কারণে বর্তমান সরকারের সময় বেশ অস্থিতিশীল ছিলো এমসির ক্যাম্পাস। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহপরান হল রাতের আধাঁরে জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ছাত্রলীগ। একই সঙ্গে শাবি ক্যাম্পাসে বেশ কয়েক দফা ছাত্রলীগও অস্ত্রের মহড়া দেখিয়েছে। এতে সাধারন শিক্ষার্থীরা ছিলো ভয়ে তটস্থ। এছাড়া নিয়ন্ত্রহীন ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে এমসি কলেজ ছাত্র উদয়েন্দু সিংহ পলাশ নিহত হয়েছিল। ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের ভেতরে থাকা বিএনপি জামায়াতের দোসররা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, এরপরও ঘটনার পর পর ছাত্রলীগের জেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ ঘটনাকে তিনি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেও দাবি করেন। সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রাহাত তরফদার জানিয়েছেন, কোর্ট পয়েন্টের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ দুঃখ প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সিলেট জেলা কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মো. আইয়ূব জানান, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে ছবি ও ফুটেজ দেখে তাদের চিহিৃত করা হয়েছে। তার ছবি নিয়ে এখন অভিযান চলছে।