শীর্ষবিন্দু নিউজ ডেস্ক: সুইডিশ রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও ডিনামাইটের উদ্ভাবক আলফ্রেড নোবেলের নামে প্রবর্তিত পুরস্কার নোবেল পুরস্কার নামে পরিচিত। পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি, সাহিত্য ও অর্থনীতি-এ জ্ঞানের এ ছয় শাখায় দেওয়া হয় বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানের এ পুরস্কার।
১৯০১ সাল থেকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। সেসময় অর্থনীতি ছিলনা পুরস্কার প্রদানের তালিকায়। ১৮৯৫ সালে নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়। নোবেলের উইলমতে পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে অর্থনীতি শাস্ত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কথা চিন্তা করে সুইডিশ রিক্স ব্যাংকের সৌজন্যে নোবেলের স্মরণে ‘অর্থনীতি বিজ্ঞানে সেরিস রিক্স ব্যাংক প্রাইজ’ শীর্ষক পুরস্কারটি প্রবর্তিত হয়। ১৯৬৮ সালে রিক্স ব্যাংকের ৩০০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এ পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে প্রথম অর্থনীতিতে নোবেল দেওয়া হয়।
প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান দিয়ে শুরু এবং অর্থনীতিতে বিজয়ীর নাম ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয় বছরের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা উৎসব।
এ বছর ৭ অক্টোবর চিকিৎসায় , ৮ অক্টোবর পদার্থ বিজ্ঞানে, ৯ অক্টোবর রসায়নে, ১০ অক্টোবর সাহিত্যে, ১১ অক্টোবর শান্তিতে ও ১৪ অক্টোবর অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়।
চিকিৎসা: কোষ নিয়ে গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী। তারা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের জেমস রথম্যান ও র্যান্ডি শেকম্যান এবং জার্মানির টমাস সুডহফ। তাদের গবেষণার ফলে কোষ থেকে কোষে এনজাইম, হরমোন, রাসায়নিক সংকেত ইত্যাদি কীভাবে প্রবাহিত হয় সে সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা গেছে।
স্টকহোমের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিন নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেন নোবেল কমিটি ফর ফিজিওলজি অর মেডিসিনের সেক্রেটারি গোয়েরন হ্যানসন। তিনি বলেন, এ তিন বিজ্ঞানী গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, কোষ থেকে কোষে রাসায়নিক অণুর পরিবহন কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
তিন বিজ্ঞানীর গবেষণায় জানা গেছে, কোষে বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রের মতো ভিসাইকলগুলো কীভাবে কাজ করে। এগুলো এনজাইম, নিউরোট্রান্সমিটার, হরমোন ইত্যাদি পরিবহন করে কোষের বাইরে নিয়ে আসে। কোষ এসব অন্য কোষে ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই কোষ থেকে কোষে বিভিন্ন উপাদান ও সংকেত পরিবাহিত হয়। মানব কোষে তৈরি হওয়া ইনসুলিন এ প্রক্রিয়াতেই রক্তে মেশে। সঠিক সময়ে যথাযথভাবে এ কাজগুলো সম্পন্ন না হলেই দেখা দেয় জটিলতা। ডায়াবেটিস, মস্তিষ্ক বিকৃতিসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ।
রসায়ন: রাসায়নিক সমীকরণকে কম্পিউটার পদ্ধতির মাধ্যমে দৃশ্যমান করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করায় এবারে রসায়নে নোবেল পেলেন মার্কিন তিন বিজ্ঞানী। এরা হলেন- মার্টিন কারপ্লাস, মাইকেল লেভিট ও আরেই ওয়ারশেল।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ভাষ্য, রসায়নকে সাইবারজগতে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বের জন্য রসায়নে নোবেল পেলেন তিন গবেষক। রাসায়নিক বিক্রিয়াকে কম্পিউটার পদ্ধতির মাধ্যমে দৃশ্যমান করার প্রক্রিয়াটি নতুন ধরনের ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগানো সম্ভব।
গবেষকেদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে কম্পিউটারের সাহায্যে রসায়নের জটিল ও রহস্যময় প্রক্রিয়ার ‘ম্যাপ’ তৈরি করা সম্ভব। রসায়নিক প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানা সম্ভব হওয়ায় এর মাধ্যমে নতুন ব্যবহারিকক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
পদার্থ: পদার্থবিদ্যায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানী পিটার হিগস ও বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কোইস অ্যাংলার্ট। ‘হিগস-বোসন’ কণার অস্তিত্বের ধারণা দেয়ায় তাদের এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। নোবেল কমিটি জানায়, অতিপারমাণবিক কণার ভর উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে ‘হিগস-বোসন’ বা ঈশ্বর কণার অস্তিত্বের তাত্ত্বিক ধারণা দেয়ায় তাদের এই পুরস্কার দেয়া হল।
১৯৬০-এর দশকে এই দুই বিজ্ঞানীসহ একদল কণাতত্ত্ববিদ একটি মডেল প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে পরমাণুর কিছু প্রাথমিক কণার ভরের উৎস ব্যাখ্যা করা হয়। ওই মডেলে একটি কণার কথা বলা হয়, যার নাম রাখা হয় পিটার হিগস ও বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে।
তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার এই মত অনুযায়ী, মহাবিশ্বের সবকিছুই ‘ভর’ পেয়েছে এই হিগস-বোসন কণার মাধ্যমে। এ কারণে এই কণার নাম হয়ে যায় ‘ঈশ্বর কণা’। তত্ত্বের সেই হিগস-বোসন কণা যে বাস্তবেও আছে- ২০১২ সালে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইউরোপের সার্ন গবেষণাগারে।
সাহিত্য: এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কানাডীয় সহিত্যিক এলিস মুনরো। মুনরো তার সমকালে ছোটগল্পের জন্য বিশ্বব্যাপী নন্দিত। ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেড, লাইভস অফ গার্লস অ্যান্ড উইমেন, দ্য মুনস অফ জুপিটার, দ্য লাভ অব আ গুড উইমেন প্রভৃতি এলিস মুনরোর বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।
এলিস মুনরো কানাডার ওন্টারিও’র উইংহামে ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন । ২০০৯ সালে মুনরো তার সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেন।
শান্তি: আন্তর্জাতিক রাসায়নিক অস্ত্র পর্যবেক্ষক অর্গানাইজেশন ফর দ্য প্রহিবিশন অব কেমিকেল ওয়েপন্স (ওপিসিডব্লিউ) সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসে তদারকির জন্য এ বছর শান্তি নোবেল পেয়েছে। জাতিসংঘের সহায়তায় ৬ অক্টোবর থেকে সিরিয়ায় সীমিত পরিসরে রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস শুরু করেছে সংস্থাটি। দেশটিতে আগামী ১ নভেম্বর থেকে পুরোদমে রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস চালাবে ওপিসিডব্লিউ। সিরিয়ায় পশ্চিমা আগ্রাসন এড়াতে রাশিয়ার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস চালানো হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওপিসিডব্লিউ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহাররোধ ও ধ্বংসে কাজ করে যাচ্ছে। বতর্মানে ওপিসিডব্লিউর সদস্য সংখ্যা ১৮৯। ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর এ প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক ব্যয় ৭ কোটি ৪০ লাখ ইউরো। নেদারল্যান্ডসের হেগে ওপিসিডব্লিউ’র সদর দফতর অবস্থিত।
অর্থনীতি: সম্পদ মূল্যের প্রায়োগিক বিশ্লেষণ দেওয়ার জন্য এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তিন মার্কিন অর্থনীতিবিদ। তারা হলেন ইউজিন এফ. ফামা, লার্স পিটার হানসেন ও রবার্ট জে শিলার।
ইউজেন এফ ফামা: যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ইউজেন এফ. ফামার ১৯৩৯ সালে বোস্টনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক দেখান, দামের সঙ্গে দ্রত নতুন তথ্যের সংযোজনের ফলে স্বল্প মেয়াদে শেয়ারের দাম নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। নোবেল কমিটি বলেছে, ফামার ফলাফল পরবর্তী গবেষণার জন্য ‘খুবই গভীর প্রভাব’ ফেলেছে এবং বাজারের চরিত্রে পরিবর্তনও এনেছে।
লার্স পিটার হানসেন: যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫২ সালে জন্ম লার্স পিটার হানসেসেনর। তিনি মিন্নেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সম্পদের মূল্য সংক্রান্ত তথ্য পরীক্ষায় পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি বের করায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
রবার্ট জে শিলার: যুক্তরাষ্ট্রের ডেটট্রয়েট শহরে ১৯৪৬ সালে জন্ম রবার্ট জে শিলারের। তিনি ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে ১৯৭২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিলার ১৯৮০-এর দশকে দেখান যে, করপোরেট লভ্যাংশের চেয়ে স্টক প্রাইজের উঠা-নামা খুব বেশি নয়।