আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় মঙ্গলবার বিকাল থেকে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভের সূচনা করে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ। এক পর্যায়ে তা পরিণত হয় সব শ্রেণিপেশার জনতার সমাবেশে। দিন-রাত টানা সেখানে অবস্থান করছে হাজার হাজার আন্দোলনকারী। শুক্রবার বিকাল ৩টায় হয় মহাসমাবেশ। এই মহাসমাবেশ থেকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়েছে।
এরই মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়। মানুষের একটি দাবি কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের সব শ্রেণিপেশার মানুষ, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশুরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজপথে অবস্থান করছে। চলছে শ্লোগান, বক্তৃতা, আবৃত্তি।
এদিকে সিলেটনগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৃহস্পতিবারের মতো শুক্রবারও জড়ো হয়েছে হাজারো মানুষ। বেলা ২টার পর নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে এসে জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী, শিক্ষক ও ছাত্ররা। সাড়ে ৩টায় শুরু হয় সমাবেশ। কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে না ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সমাবেশে বক্তৃতার সঙ্গে চলছে গান, স্লোগান ও কবিতা। সমাবেশে বক্তব্য চলাকালে শহীদ মিনারের সামনের সড়ক এলাকাকে শহীদ মনির-তপন-জুয়েল চত্বর ঘোষণা করা হয়। উল্লৈখ্য, ১৯৮৮ সালে চৌহাট্টা এলাকায় ছাত্রশিবিরের হামলায় তারা নিহত হয়েছিলেন। এখানে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্রনেতারা বক্তব্য দেন। তবে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকে বক্তব্য দিতে দেয়া হয়নি।
শাহবাগে মহাসমাবেশের লাখো কণ্ঠে মুখরিত ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই” স্লোগান প্রিজন সেলেও পৌঁছার কথা। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক মো. আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “মহাসমাবেশের প্রতিক্রিয়ায় তার (গোলাম আজম) মধ্যে অস্থিরতা, অস্বাভাবিকতা, দুশ্চিন্তা বা চিন্তক্লিষ্টতা বা এ ধরনের কিছু নাই। সে স্বাভাবিক। সে সুস্থ আছে, খাওয়া খাচ্ছে ঠিকভাবে।” “প্রত্যেকদিনই সেখানে কর্তব্যরত নার্স ও ডাক্তাররা আমাকে সকালে ফিডব্যাক দেয়। আজকেও আমি ফিডব্যাক পেয়েছি। তার ভিতরে কোনো ধরনের পরিবর্তন নাই।”
ওদিকে শাহবাগের অভূতপূর্ব মহাসমাবেশে একাত্তরের হত্যাকারী আর ধর্ষকদের ফাঁসি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন লাখো জনতা। শপথে বলা হয়, “একাত্তরের ঘৃণ্য রাজাকার, আল বদর, গণহত্যা ও ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদণ্ড না হওয়া পর্যন্ত এই গণমানুষের মঞ্চ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
গত ১২ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ৫২ দফা অভিযোগ উত্থাপন করে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারের আবেদন জানায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তা পুনর্বিন্যস্ত করে ৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার তীব্র বিরোধিতাকারী গোলাম আযম ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন, যাদের সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযম সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭১ থেকে ৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা। ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি।
বাংলাদেশে ফেরার পর দীর্ঘদিন তার নাগরিকত্ব না থাকলেও বিগত বিএনপি সরকারের সময় উচ্চ আদালতের আদেশে নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আযম। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওইদিনই দেয়া আদেশে তাকে ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়। হাজির হয়ে তিনি জামিন আবেদন করলেও আদালত তা খারিজ করে তাকে কারাগারে পাঠায়। কারাগারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ৯০ বছর বয়সী জামায়াতের এই নেতাকে পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগে বাঙালির গণজাগরণ সুরের প্রেরণা হয়ে ছুঁয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের সংগীত শিল্পী কবীর সুমনকেও। শুক্রবার নিজের ওয়েবসাইটে পোস্ট করা‘গণদাবি’ গানে শাহবাগের এই গণ জমায়েত নিয়ে তিনি গেয়েছেন – ‘বসন্ত আজ বন্ধুরা দেখ গণদাবি হয়ে বাঁচে’। যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান তরে গত মঙ্গলবার থেকে ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন হাজারো ছাত্র-জনতা। গত চার দিন ধরে সকাল-দুপুর-রাত প্রতিবাদ চলছেই।
সুমনের গানে উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের এই দাবির কথা। উঠে এসেছে তার সমর্থনের কথাও। শারীরিকভাবে শাহবাগের সমাবেশে হাজির থাকতে না পারলেও গানের মধ্য দিয়ে আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন তিনি।
বিমানে উড়তে ৩০ মিনিট, এতো কাছে তবু দূর/বিল-কূল নেই পাসপোর্ট-ভিসা,সীমানা চিনি না সুর
সীমানা চিনি না আছি শাহবাগে-আমার গিটারও আছে/বসন্ত আজ বন্ধুরা দেখ গণদাবি হয়ে বাঁচে
বাঁচো গণদাবি-বাঁচো গণদাবি, আসল বিচার চাই/যার যা পাওনা তাকে সেটা দাও-গণদাবি একটাই|
শুক্রবার বিকাল ৪টা ৫৭ মিনিটে ঢাকার শাহবাগ যখন ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’ স্লোগানে উত্তাল, ঠিক তখনই সুরে কথা বসিয়ে সুমন তার ‘গণদাবি’ পৌঁছে দেন অনলাইনে।
সব মিলিয়ে পুরো শাহবাগ যেন ৫৬ বর্গমাইলের এক টুকরো বাংলাদেশ।
Leave a Reply