আনোয়ার শাহজাহান: সিঙ্গাপুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। মোট আয়তন ৭১৯.৯ বর্গকিলোমিটার (২৭৮.০ বর্গমাইল) এর মধ্যে স্থলভূমির মোট আয়তন ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার।
সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যা ৫৬ লক্ষ ৭ হাজার ৩ শত (আনুমানিক, ২০১৬ সাল)। দেশটিতে জাতিগোষ্ঠীর সিংহভাগ হলেন চীনা (৭৪.৩%)। এর মধ্যে ৩৩.২% বৌদ্ধ, ১৮.৮% খ্রিস্টান এবং ১৪.০% মুসলমান ধর্মাবলম্বী লোক বাস করেন।
প্রথম রোগী শনাক্ত: ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রথম রোগী ধরা পড়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথ্যের ভিত্তিতে ২৩ জানুয়ারি এ তথ্য নিশ্চিত করে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।
প্রথম বাংলাদেশি রোগী শনাক্ত: ৯ ফেব্রুয়ারি রবিবার প্রথমবারের মত কোনো বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দ্য স্ট্রেইট টাইমস রোববার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমানও বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে নিশ্চিত করেন।
স্ট্রেইট টাইমসের খবরে বলা হয়, সিঙ্গাপুরে তিনজন নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশের এবং অন্য দুজন সিঙ্গাপুরের নাগরিক। রিপোর্ট আরো উল্লেখ করে, ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে কেউ কখনোই চীনে ভ্রমণ করেননি।
নিরাপত্তার স্বার্থে সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ওই বাংলাদেশির পরিচয় প্রকাশ করেনি। তবে এতটুকু জানা যায়, ৩৯ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশি সিঙ্গাপুরে একজন বৈধ পুরুষ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আক্রান্তের পর তাকে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিস বা এনসিআইসিডিতে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় বলে জানিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান।
সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের এক কর্মীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আমাদের জানিয়েছে। নিরাপত্তার খাতিরে ৩৯ বছরের ওই বাংলাদেশির পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
দ্য স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই তার শরীরে অসুস্থতা দেখা দেয়। কিন্তু তাকে ৭ ফেব্রুয়ারি চাঙ্গি জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। বাংলাদেশি আক্রান্ত ওই ব্যক্তি এর আগে ভাইরাসের লক্ষণ বুঝতে পেরে ৩ ফেব্রুয়ারি সাধারণ একটি ক্লিনিকে যান। পরবর্তীতে ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যান চেঙ্গি জেনারেল হাসপাতালে। ৮ ফেব্রুয়ারি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে করোনাভাইরাসে তার আক্রান্তের বিষয়টি চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করে।
অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি সিঙ্গাপুরের মোস্তফা সেন্টারে (১৪৫ সৈয়দ আলাভি সড়ক) গিয়েছিলেন এবং দ্য লিও ডরমিটরিতে (২৫ বুকিত রোড) বসবাস করছিলেন।
সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মোস্তফা সেন্টারে লোকজনের ভিড় লেগেই ছিল। ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক কেনার জন্য সেখানে হাজার হাজার লোক প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশটিতে মোট আক্রান্তের বেশিরভাগই অভিবাসী শ্রমিক। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সিঙ্গাপুরের কাজ করতে গিয়েছিলেন। প্রায় ৯ হাজারের বেশি অভিবাসী শ্রমিক ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা সিংহভাগ অর্থাত্ প্রায় ৪ হাজারেরও কাছাকাছি। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০,১৪১।
সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের দেওয়া তথ্যমতে, প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি প্রবাসী বর্তমানে দেশটিতে অবস্থান করছে। যাদের বেশিরভাগই সেখানকার ডরমিটরিগুলোতে বসবাস করেন।
বাংলাদেশি শ্রমিকরা বেশি আক্রান্ত: সম্প্রতি সংবাদপত্রে এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল মান্নান বাংলাদেশিরা বেশি করে আক্রান্তের কারণ তুলে ধরেন। মি. মান্নান দীর্ঘদিন যাবত সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। সিঙ্গাপুরে বসবাস এবং কর্মরত বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বেশি হওয়ার একটি কারণ অল্প জায়গায় অনেক বেশি শ্রমিকের বসবাস করা।
এছাড়া সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা সবসময় দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করেন, ফলে তাদের মধ্যে বেশ দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে মনে করেন মান্নান। তিনি বলেন, বাঙালি শ্রমিকদের সমস্যা হচ্ছে প্রতি রোববার তারা এক জায়গায় জড়ো হয়। মোস্তফা মার্টের সামনে একটা মাঠ আছে। সেখানে তারা দলবদ্ধভাবে বসে আড্ডা দেয়, খাবার খায়। ইন্ডিয়ান বা চায়নিজরা এটা করে না।
মান্নান বলেন, রোববার কেহ মোস্তফা মার্ট এলাকায় যান, তাহলে নড়তেই পারবেন না। লোক গিজগিজ করে সেখানে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা সবাই এক জায়গায় থাকতে চায়। এছাড়া শুরু থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে তেমন কোনও সচেতনতা ছিল না বলেও জানান এই সিঙ্গাপুর প্রবাসী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল মান্নান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের ধারণা ছিল যে করোনাভাইরাস তারা আক্রান্ত হবেন না। এই রোগ শুধু চীনাদের আর বয়স্কদের জন্য।
এছাড়া সিঙ্গাপুরে বসবাসরত বাংলাদেশি সাংবাদিক ওমর ফারুকী শিপন জানান, বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে প্রথমদিকে দুই-একজনের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকলেও তারা সেটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। অনেকে বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করেছেন। ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
২২ এপ্রিল বুধবার সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৪১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়। তবে ঐদিন দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৬ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। এরমধ্যে ১ হাজার ৫ জনই ছিলেন অভিবাসী শ্রমিক। বাকি ১১ জন সিঙ্গাপুরের নাগরিক কিংবা দেশটির স্থায়ী বাসিন্দা।
সিঙ্গাপুরের জাতীয় দৈনিক দ্য স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই প্রবাসী শ্রমিক।
২১ এপ্রিল পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরে করোনায় আক্রান্ত প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৬২ জন। আজ আরও প্রায় এক হাজার শ্রমিক আক্রান্ত হওয়ায় বাংলাদেশি আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করোনায় প্রথম মৃত্যু: ২১ মার্চ শনিবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথমবারের মতো দুই জন রোগী মারা যান। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল দেশটিতে এটিই প্রথম কোনো মৃত্যুর ঘটনা।
সিঙ্গাপুরের জাতীয় দৈনিক দ্য স্ট্রেইট টাইমসের তথ্য থেকে জানা যায়, সিঙ্গাপুরে ৭৫ বছর বয়সী এক নারী ও ৬৪ বছর বয়সী এক ইন্দোনেশীয় কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই নারী আগে থেকেই হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে তার শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি শনাক্ত হলে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়। ২৬ দিন আইসিইউতে থাকার পর তার মৃত্যু হয়েছে।
আর ওই ইন্দোনেশীয় নাগরিক ১৩ মার্চ থেকে আইসিইউতে ছিলেন। তার আগে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
সর্বশেষ: ২২ এপ্রিল বুধবার সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০,১৪১। এর মধ্যে ১১ জন রোগী মারা যান। ৮৩৯ জন রোগী সুস্থ হয় বাড়ি ফিরেন।
সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি হিসিয়েন লুং ২১ এপ্রিল মঙ্গলবার লকডাউনের মেয়াদ আগামী ১ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। খবর দ্যা গার্ডিয়ান’র। দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি হিসিয়েন লুং বলেন, করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন আক্রান্ত হচ্ছে। লকডাউনের কঠোরতা ভেঙ্গে পড়ায় এমন হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী লি তাঁর ভাষণে বলেন, সরকার ডরমিটরিতে অবস্থানরত অভিবাসীদের সিঙ্গাপুরের স্থানীয় নাগরিকদের মতোই দেখভাল করবে, যা অভিবাসীরা ইতিমধ্যে পেয়ে আসছেন। সিঙ্গাপুরে কোনো অভিবাসী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সিঙ্গাপুর সরকার তার চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করছে।
প্রধানমন্ত্রী ভাষণের শুরুতে সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম বাংলাদেশির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত প্রথম বাংলাদেশি দুই মাস আইসিইউতে থাকার পর এখন জেনারেল ওয়ার্ডে আছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। তাঁর সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে। আশা করি তিনি খুব দ্রুত তাঁর সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে কোলে তুলে নিতে পারবেন।
এদিকে সিঙ্গাপুরে কয়েক হাজার বাংলাদেশি কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। প্রবাসীদের আশা, এই সঙ্কটে সহযোগিতার হাত আরও বাড়িয়ে দেবে বাংলাদেশ হাইকমিশন।