সিলেট বিএনপি এখন দুই ধারায় বিভক্ত। এক ধারায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও অপর ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ সিলেটে অবস্থানরত দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। আবারো সেই পুরনো দ্বন্দ্ব সিলেট বিএনপিতে।
প্রতিবাদে সব সময়ই অগ্রজ একাংশের নিয়ন্ত্রক এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। এবারো তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এবার জামান কেবল দলই ছাড়েননি, জানিয়েছেন মনের ক্ষোভও। জামানের এই পদত্যাগ নিয়ে টালমাটাল এখন সিলেট বিএনপি। শুধু তাই নয়, এ ঘটনার পর সিলেট বিএনপি’র চাপা ক্ষোভ এখন প্রকাশ্যে এসেছে।
এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান বলেন, অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো গতকাল সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষিত হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ সেচ্ছাসেবক সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষিত হলো আমার মতামত ও পরামর্শ উপেক্ষা করে। সর্বোপরি যেসব সহযোদ্ধা আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন বাজি রেখেছিল, গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, এমনকি সমাজ-সংসার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, তাদেরকে চরমভাবে উপেক্ষা করে উপহাসের পাত্রে পরিণত করা হলো।
তিনি আরো বলেন, আজকে অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে জানতে ইচ্ছে করে আপনার দলে নেতৃত্ব পেতে হলে যোগ্যতার মাপকাঠিটা কি? যারা দেশ ও দলকে ভালবাসে, জীবন বাজি রাখে, দুর্দিনে যারা বিশ্বস্ত থাকে, বন্দুকের নলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, কমিটিতে তাদের পদ পাওয়া উচিত, নাকি যারা লবিং-তদবির অথবা বিশেষ ব্যবস্থায় সবকিছু হাসিল করে তাদের পাওয়া উচিত?
যে দলটাকে ভালবাসে তিল তিল করে বিনির্মাণ করেছিলাম আজকে সেই দলে আমরাই অনাহুত। আপনারা প্রায়শই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, রাষ্ট্রের কাছে ন্যায় ইনসাফের দাবি তুলেন কিন্তু নিজের অন্তর আত্মাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব কিনা?
প্রবীণ নেতা এমএ হকের জীবদ্দশায় তিনি বিএনপির ভেতরে বহমান এই বিভক্তিকে দৃশ্যমান হতে দেননি। নিজে থেকেই বিবাদ মেটানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আর এম এ হকও ছিলেন বিএনপির সব বলয়ের নেতাদের কাছে আস্থার প্রতীক। কিন্তু এম এ হকের মৃত্যুর পর বিএনপির ভেতরকার দ্বন্দ্ব ফের চাঙ্গা হয়েছে। সিলেট-১ আসনে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেকটা একাই খেলা দেখিয়েছেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। সে সময় সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান নিয়ে নিজে তার উপর চলা নির্বাচনী অবিচারের বিচার দাবি করেন। ওই সময় অসহায় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও তার সঙ্গে সিলেট বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পাননি। গ্রেপ্তার ও মামলার ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির সিলেট-১ আসনে এখনো বিএনপির অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। কারণ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবীন চৌধুরী ও সাবেক নেতা ইনাম আহমদ চৌধুরী দল ছেড়েছেন অনেক আগেই। ফলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির একক নেতা হিসেবে রাজনীতি করছেন। আর সিটি করপোরেশন দখলে বিএনপির আরেক কেন্দ্রীয় নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর।
আরিফ বলয়ের নেতারা জানিয়েছেন, পরপর দুইবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির অপর বলয়ের তেমন সহযোগিতা পাননি। দুইবার সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এখন সিলেট-১ আসনেও চোখ রয়েছে আরিফুল হক চৌধুরীর। এ কারণে সিলেট বিএনপির নিয়ন্ত্রক খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও আরিফুল হক চৌধুরী এখন একে অপরের দূরত্বে অবস্থান করছেন।
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে অনেকটা স্বতন্ত্র ভূমিকায় সিলেটের রাজনীতির আলোচিত নেতা এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। মামলার পর মামলায় বিপর্যস্ত হওয়ার পর তিনি চলে গিয়েছিলেন ব্যাকফুটে। এই সময়ে প্রথমে সিলেটে ছাত্রদলকে সাজাতে গিয়ে জামান অনুসারীদের ‘মাইনাস’ প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে যুবদল, এরপর জেলা বিএনপি এবং সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবক দলে জামান অনুসারীদের বাদ দেয়া হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন জামান। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে জামানের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে এক সময়ের রাজনীতিক প্রতিপক্ষ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক, ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতার।
তারাই কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে সিলেট বিএনপিতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে- সিলেট বিএনপিতে যা কিছু হবে তাদের মতেই এবং তাদের সিদ্ধান্তে হতে হবে। অপরদিকে খন্দকার মুক্তাদিরের দিকে ঝুঁকছেন সিলেটের পদ-পদবির লবিংয়ে থাকা নেতারা। ফলে দিন দিন বহর বড় হচ্ছে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের। খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের পিতা খন্দকার আব্দুল মালিক ছিলেন বিএনপির দুর্দিনের কাণ্ডারি। তার নেতৃত্বেই সিলেট বিএনপি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ফলে বিএনপির প্রবীণ নেতাদের কাছে এখনো গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে খন্দকার আব্দুল মালিকের নাম উচ্চারিত হয়। আর পিতার রাজনীতির সূত্র ধরে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরও সিলেটে খুব সহজেই অবস্থান সুদৃঢ় করেন। খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের এই সুদৃঢ় অবস্থানের কারণেই সিলেটে অবস্থান করা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা নাখোশ।
অবশ্য এডভোকেট শামসুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্যে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের নাম উচ্চারণ করেননি। তেমনি আরিফুল হক চৌধুরীর প্রসঙ্গও টেনে আনেননি। জামানের পদত্যাগের পর সিলেট বিএনপিতে রীতিমত ভূমিকম্প হচ্ছে। এই অবস্থায় দুই বলয়ের নেতারা যার যার অবস্থান থেকে সুবিধাজনক বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে- আফসোসের প্রসঙ্গটি তুলে এনেছেন জামানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি জামান ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। আমার এই প্রাপ্তিতে তার খুশী হওয়ার কথা। এখানে তিনি যদি বিরোধিতা করেন সেটি হবে তার নিজস্ব বিষয়। এখানে কিছুই বলার নেই। তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী ও আরেক কেন্দ্রীয় নেতা আবুল কাহের শামীম জামানের এই পদত্যাগকে ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে।
আরিফুল হক চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জামান তার ক্ষোভ থেকে পদত্যাগ করেছে। যখন ত্যাগী নেতাকর্মীরা দলে অবমূল্যায়িত হয় তখন খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। আর কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের শামীম বলেছেন- অনেক সময় হয়তো ত্যাগীরা মূল্যায়িত হন না। কিন্তু দলের প্রতি কমিটমেন্ট থাকলে আজ হোক আর কাল হোক কাজের মূল্যায়ন হবেই। আন্দোলন সংগ্রামে জামানের অনেক অবদান আছে, কিন্তু দলের বিরুদ্ধে সে যেভাবে বিতর্কিত কথা বলেছে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। অভিমান করে তার দলত্যাগ উচিত হয়নি।
উল্লেখ্য, সিলেট বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন কেন্দ্রীয় সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। বুধবার রাতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দেয়া এক চিঠিতে এ পদত্যাগ করেন। পরে সিলেটে তার অনুসারীদের সঙ্গে এ নিয়ে সভায় এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি জানান, তাঁর মতামত ও পরামর্শ উপেক্ষা করে সদ্য ঘোষিত সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি অনুমোদন দেওয়ায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন।
Leave a Reply