সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ১২:১২

ইভ্যালির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা কি ক্ষতিপূরণ পাবেন?

ইভ্যালির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা কি ক্ষতিপূরণ পাবেন?

শীর্ষবিন্দু নিউজ, ঢাকা / ১৯৪
প্রকাশ কাল: শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী (প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান) শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিকালে রাসেলের মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এর আগে তাদের দুজনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় প্রতারণার মামলা দায়ের করেন ইভ্যালির এক গ্রাহক।

ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার অভিযোগে উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো পথ এখনো তৈরি হয়নি। কীভাবে তারা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন তারও কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।

এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রেফতার কোনো সমাধান নয়। কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিরা গ্রেফতার হলেও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে এমনিতেই মানুষ আর্থিক সংকটে আছে। তার মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ই-কমার্সে টাকা দিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি আলমাস কবীর বলেছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য দিচ্ছে না, এটা সত্য। এখন এদের গ্রেফতার করে জেলে ভরলে তো গ্রাহক টাকা ফেরত পাবেন না। তার পরামর্শ হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের তরফ থেকে প্রশাসক বসিয়ে তাদের যে সম্পদ আছে তা বিক্রি করে সব টাকা দেওয়া না গেলেও যতটা সম্ভব গ্রাহকদের টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

তবে অনেকে আবার এদের শাস্তিরও পক্ষে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, এই খাতে আস্থা ফেরাতে দোষীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুরও মনে করেন, যারা প্রতারণা করেছে, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই ধরনের প্রতারণা সামনের দিনে ঘটতেই থাকবে।

সর্বশেষ গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি করতে না পারার কারণে একজন গ্রাহকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোছা. শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। কাস্টমার ও মার্চেন্টদের কাছে ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইভ্যালির প্রকৃত দেনার পরিমাণ ৫৪৪ কোটি টাকা। দায়ের বিপরীতে তাদের চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ দুটির যোগফল মোট ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

এর আগে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক বনানী থানার ওসি তদন্ত শেখ সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। নিরাপদ ডটকম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকেও (সিইও) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শাহরিয়ার খান নামে ঐ ব্যক্তি ই-কমার্স সাইট খুলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়াও কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা গ্রেফতার হয়েছেন।

রফিকুল ইসলাম নামে একজন গ্রাহক বলেন, তিনি ইভ্যালির মাধ্যমে প্রায় ৪ লাখ টাকা দিয়েছেন কিছু পণ্য কেনার জন্য। এখন পণ্যও পাননি, টাকাও পাননি। এই টাকা না পাওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। আমিরুল ইসলাম নামে একজন জানিয়েছেন, ১ লাখ ৮০ হাজার মোটরসাইকেল ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় পাওয়ার অফারে তিনি টাকা দিয়েছেন। এখন টাকাও গেল, মোটরসাইকেলও পেলেন না। অনেক কষ্ট করে এই টাকা জোগাড় করেছিলেন। প্রতারণার শিকার হতে পারেন জানার পরও কেন টাকা দিয়েছিলেন জানতে চাইলে আমিরুল বলেন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনার কারণে চাকরি চলে গেছে। রাইড শেয়ারিংয়ে চালানোর জন্য মোটরসাইকেলটি কিনতে চেয়েছিলেন। ধার করে ঐ টাকা দিয়েছিলেন। এখন পথে বসে গেলেন।

এমন অসংখ্য মানুষ ই-কমার্সে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেছেন, এখন ই-কমার্সে অভিযোগের পরিমাণ আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব প্রতিকারের চেষ্টা করা হচ্ছে।

গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বিতর্কের মুখে রয়েছে ইভ্যালি। তার পরও কেন গ্রাহকেরা সেখানে আস্থা রেখেছে, জানতে চাইলে গ্রে অ্যাডভার্টাইজিংয়ের বাংলাদেশের কান্ট্রি হেড গাউছুল আযম শাওন বলেন, নামকরা প্রতিষ্ঠান যখন তাদের বিজ্ঞাপন করে, তখন মানুষ কেন আস্থা রাখবে না? নাম করেই যদি বলি, দুই দিন আগেও বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর ছিল ইভ্যালি। আমাদের ক্রিকেটাররা ইভ্যালি লেখা জার্সি গায়ে জড়িয়ে যখন মাঠে নামেন, তখন সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা যায়? বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো দায় আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন করলে সেই প্রোডাক্ট সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। সেটা মডেলকেও জানাই।

বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন কেন করেন তারকারা, জানতে চাইলে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপি বলেন, আমি যদি জানতাম ই-অরেঞ্জ প্রতারণা করবে, তাহলে কি আর তাদের শুভেচ্ছা দূত হতাম? এগুলো আসলে আমাদের জানার সুযোগ নেই। কেউ কি বলে আমি প্রতারণা করব, আপনি আমাদের দূত হন?

কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন করার আগে সেই পণ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি বলেন, তাহলে তো আপনাকে মালিকানায় ঢুকতে হবে। ম্যানুফেকচার যেখানে হচ্ছে, সেখানে যেতে হবে। কোম্পানির সিইও যারা থাকে বা শেয়ারহোল্ডার যারা থাকে, তারা খোঁজখবর রাখতে পারে। যারা এই বিজনেসটা করছে এটা তাদের বিষয়। শুভেচ্ছা দূতের কাজ হচ্ছে, আপনি আমাদের কোম্পানির শুভেচ্ছা দূত, আপনার সঙ্গে এত টাকার চুক্তি, আপনি ছয় মাসে তিন দিন, বছরে ছয় দিন সময় দেবেন। সারা পৃথিবীতে এটাই প্রচলিত। আপনি ধরেন একটি মুদি দোকান দিতে হলেও লাইসেন্সের দরকার হয়। লাইসেন্স তো কোনো শুভেচ্ছা দূত দেন না। ফলে যারা লাইসেন্স দেন, এটা দেখা তাদের দায়িত্ব।

ইভ্যালির বিরুদ্ধে আট ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে প্রচলিত বিভিন্ন আইনভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ সদর দফতরের একটি তদন্ত টিম অনুসন্ধান করে নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে অর্ডার করা পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি না দেওয়া, গ্রাহকদের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ না রাখা, পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলেও টাকা ফেরত না দেওয়া- ইত্যাদি অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে পাওনা টাকা নগদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ফেরত না দিয়ে ই-ওয়ালেটে যোগ করা এবং ই-ব্যালেন্স থেকে পণ্য কেনার সময় ১০০ শতাংশ ব্যবহার করতে না দেওয়ার অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ইভ্যালি থেকে অনেক সময় কমমূল্যের ও মানহীন পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে ইভ্যালি। লোভনীয় ডিসকাউন্ট ও ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে দ্রুত গ্রাহকদের কাছে পরিচিতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সময়মতো পণ্য না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে সমালোচনার শীর্ষে চলে আসে। মাঝে ইভ্যালিতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ কর‌বে ব‌লে ঘোষণা দি‌য়ে‌ছিল দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ যমুনা। কিন্তু সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে গ্রুপটি।

জানা গেছে, ই-ভ্যালির কার্যক্রম শুরুর দুই বছর পার না হতেই নানা কৌশলের আশ্রয়ে প্রতিষ্ঠানটি দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক কোটি টাকা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে শুধু প্রতারণা নয়, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ইভ্যালি যা করেছে তা হলো মাছের তেলে মাছ ভাজা। আবার কিছু তেল সেখান থেকে সরিয়েও ফেলেছে। এই ধরনের ব্যবসা শেষপর্যন্ত টেকে না। ইভ্যালি যেভাবে ব্যবসা করেছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ইভ্যালি দুটি ক্ষতি করেছে- প্রথমত, গ্রাহকের ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, ইকমার্সের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট। এরপর থেকে দেশি কোনও প্রতিষ্ঠানকে জনগণ বিশ্বাস করবে না। এই সুযোগে বিদেশি কোম্পানি এসে নিয়ম মেনে ব্যবসা করবে। পরে তাদের দাপটে দেশে নতুন কোনও প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতেই পারবে না।’

উল্লেখ্য, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ছিল প্রায় ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। দেশের প্রায় ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। পণ্য কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক অফার দিয়ে ব্যবসা করছিল ইভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি থেকে বলা হতো ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। ‘সাইক্লোন’, ‘থান্ডারস্টর্ম’, ‘আর্থকোয়াক’সহ নানা ধরনের লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হতো। দেওয়া হতো অস্বাভাবিক মূল্যছাড়। কিছু গ্রাহক লাভ পেলেও বেশিরভাগই আছেন টাকা ফেরতের অনিশ্চয়তায়। এর আগেও ডেসটিনি, যুবক, নিউওয়ে, জিজিএনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে লাখ লাখ গ্রাহক প্রতারিত হয়েছিলেন। তারাও এখন পর্যন্ত তাদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাননি। ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরাও গ্রেফতার হয়ে এখনো জেলে আছেন।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2022