আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘সূরা তাওবা’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।
সাধারণ নিয়ম অনুসারে অন্য সূরা হতে পৃথক করার জন্য তাসমিয়াতুন বা বিসমিল্লাহ্ সূরার প্রথমে লিপিবদ্ধ করা হতাে; কিন্তু এ সূরায় মহানবী (সা.) তা লেখেননি এবং এ সূরা কোন সূরার অংশ তাও বলেননি; কাজেই মাসহাফে উসমানী তথা তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) কর্তৃক প্রকাশিত কুরআনে এই সূরার সূচনাতে বিসমিল্লাহ লেখা হয়নি, সূরায়ে আনফাল এর পূর্বে অবতীর্ণ হওয়ায় তা এটার পূর্বে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। এ সূরাটি সূরায়ে আনফালের সাথে পঠিত হলে এর পূর্ব বিসমিল্লাহ পড়তে হয় না। অন্যথায় বিসমিল্লাহ পড়তে হয় ।
নামকরণ: এ সূরাটি দু’টি নামে পরিচিতঃ আত্ তাওবাহ ও আল বারাআতু। তাওবা নামকরণের কারণ, এ সূরার এক জায়গায় কতিপয় ঈমানদারের গোনাহ মাফ করার কথা বলা হয়েছে । আর এর শুরুতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করা হয়েছে বলে একে বারাআত (অর্থাৎ সম্পর্কচ্ছেদ ) নামে অভিহিত করা হয়েছে।
নামকরণ: এ সূরাটি দু’ নামে পরিচিত ও খ্যাত। এক নাম সূরা বারাআত, দ্বিতীয় নাম সূরা তাওবা। বারায়াতুন- বলা হয় এজন্য যে, এতে কাফিরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়িত্ব মুক্তির উল্লেখ রয়েছে। আর তাওবা বলা হয় এ জন্য যে, এতে মুসলমানদের তওবা কবুল হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর হতে চুক্তি ভঙ্গকারী সকল মুশরিকের সাথে সন্ধি চুক্তি বাতিল ঘােষণা করা হয়েছে এবং তাদের সাথে সর্ব প্রকার সম্পর্কচ্ছেদ করা হয়েছে এবং এ সূরার শেষের দিকে কতিপয় মুসলমানদের তওবা কবুল হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে অর্থাৎ তাদের গুনাহ।মাফ হওয়ার কথা ঘােষিত হয়েছে। একে উপলক্ষ করে সূরাটি তাওবাহ’ বলে নামকরণ করা হয়েছে।
সূরাটি নাজিল হওয়ার সময়কাল: এ সূরাটি তিনটি ভাষণে সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রথম ভাষণ ও শুরু হতে পঞ্চম রুকূ’র শেষ পর্যন্ত। এটা নাজিল হওয়ার সময়কাল হচ্ছে নবম হিজরির যিলকদ মাস কিংবা তার কাছাকাছি সময় । দ্বিতীয় ভাষণ: ষষ্ঠ রুক্র শুরু হতে নবম রুকূ’র শেষ পর্যন্ত। এটা নবম হিজরির রজব মাস কিংবা তার কিছু পূর্বে নাজিল হয়। তৃতীয় ভাষণ ও দশম রুকূ হতে শুরু হয়ে সূরার শেষ পর্যন্ত। এটা তাবুক যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন কালে নাজিল হয়েছিল । এতে এমন কতগুলাে অংশও রয়েছে যা বিভিন্ন সময়ে নাজিল হয়েছে।
পরে নবী কারীম (সা.) আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে এ ভাষণগুলােকে একত্রিত করে একই ভাষণের ধারাবাহিকতায় সংযােজিত করে দেন। ওপরােক্ত ভাষণগুলাে একই বিষয় সম্পর্কিত ও একই ঘটনার ধারাবাহিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট । প্রথম ভাষণে কাফির ও মুশরিকদের প্রতি চরমপত্র। তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ, ক্ষমতা লাভের পর কোনাে প্রতিশ্রুতি এবং ন্যায়-অন্যায়ের বালাই না থাকা। আল্লাহর মসজিদের কর্তৃত্ব, হজযাত্রী এবং হারাম শরীফের সেবা ঈমান জিহাদের সমকক্ষ নয় । মুশরিকরা অপবিত্র, ইহুদি খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত প্রত্যয় ও উক্তি, আহবার ও রােহবানের স্থান এবং ভূমিকা, যাকাত না দেয়ার ভয়ঙ্কর পরিণাম ইত্যাদি রয়েছে।
দ্বিতীয় ভাষণে ঈমানদার লােকদেরকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আর যারা মুনাফিকী কিংবা ঈমানের দুর্বলতা অথবা অবসাদ ও গাফলতির কারণে আল্লাহর পথে জান-মাল ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিল না তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। তৃতীয় ভাষণে মুনাফিকদেরকে তাম্বীহ এবং তাবুক যুদ্ধে যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদের ভসনা করা হয়েছে। আর যেসব লােক সত্যিকারভাবে ঈমান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পথে জিহাদে অংশ গ্রহণ হতে বিরত হয়েছিল তাদের।জন্য ক্ষমার কথা ঘােষণা করা হয়েছে। নাজিল হওয়ার ক্রমিকতার দৃষ্টিতে প্রথম ভাষণটির স্থান সর্বশেষে নির্দিষ্ট হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিষয়বস্তুর গুরুত্বের দৃষ্টিতে তার স্থান সর্ব প্রথম হওয়ার কারণে নবী করীম (সা.) সংযােজন কালে তাকেই সর্বপ্রথম রেখেছেন। আর অপর ভাষণদ্বয়কে শেষে রেখেছেন।
তাসমিয়াহ উল্লেখ না করার কারণ: এ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম লেখা হয় না। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মতভেদ ঘটেছে। তবে এ প্রসংগে ইমাম রাযীর বক্তব্যই সঠিক। তিনি লিখেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এর শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখাননি, কাজেই সাহাবায়ে কেরামও লেখেননি এবং পরবর্তী লোকেরাও এ রীতির অনুসরণ অব্যাহত রেখেছেন।
পবিত্র কুরআন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হুবহু ও সামান্যতম পরিবর্তন -পরিবর্ধন ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যেভাবে তিনি দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই তাকে সংরক্ষণ করার জন্য যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, এটি তার আর একটি প্রমাণ।
সূরার শুরুতে “বিসমিল্লাহ’ উল্লেখ না করার কারণ সম্পর্কে তাফসীরকারগণ বিভিন্ন মতামত উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সঠিক কথা তাই যা ইমাম রাযী (র.) বলেছেন। তা এই যে, নবী করীম (সা.) নিজেই এটার শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখেননি। এ কারণে সাহাবায়ে কেরামও লেখেননি। পরবর্তী কালের লােকেরাও এরই অনুসরণ করেছেন।
কুরআন মাজীদকে নবী করীম (সা.)-এর নিকট হতে যথাযথভাবে গ্রহণ করা এবং অনুরূপভাবে তাকে পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষিত রাখার ব্যাপারে যে কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে এটা তার এক সুস্পষ্ট প্রমাণ। সূরার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ উল্লেখ না করার কারণ সম্পর্কে তাফসীরকারগণ যে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন তা এই-
১. কুরআন সংকলনের সময় সাহাবীগণের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। কতেক এটাকে আলাদা সূরা বলে অভিমত প্রকাশ করেন, আর কতেক বলেন, এটা সূরা আনফালের অংশ, এ কারণে বিসমিল্লাহ লেখা হয়নি।
২. ইবনে আব্বাস, হযরত আলী (রা.)-এর নিকট সূরা তাওবার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ উল্লেখ না করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, বিসমিল্লাহ রহমত কামনা এবং নিরাপত্তা প্রার্থনার জন্য হয়ে থাকে। যেহেতু এ সূরায় কাফিরদের জন্য কোনাে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়নি, আর এতে মুনাফিকদের দুরাচার ও শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।
৩. কেউ কেউ বলেন, এ সূরা নাজিল হওয়ার সময় জিবরাঈল (আ.) বিসমিল্লাহ না নিয়ে আসার কারণেই তা লিখিত হয়নি। যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে অনুরূপভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বিষয়বস্তু: সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়। এতে ১২৯ টি আয়াত, ১৬টি রুকূ’ রয়েছে। সূরাটি তিনটি ভাষণে সম্পূর্ণ হয়েছে। এতে রয়েছে, মক্কা বিজয়কালে মুশরিকদের বিভিন্ন শ্রেণী ও তাদের প্রতি চরমপত্র, চুক্তি ও তার মর্যাদা রক্ষার নির্দেশ, ইসলামের সপক্ষে দলিল-প্রমাণ পেশ করার দায়িত্ব আলিমদের। ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলমানদের অধিক সময়ের অনুমতি দেয়া যায় না। নিষ্ঠাবান মুসলমানের আলামত, অমুসলিমদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা অবৈধ।
আল্লাহর মসজিদের কর্তৃত্ব, হজযাত্রী এবং হারাম শরীফের সেবা ঈমান ও জিহাদের সমকক্ষ নয়। আল্লাহর জিকির জিহাদের চেয়েও পুণ্য কাজ, হিজরতের মাসায়েল পূর্ণতর ঈমানের পরিচয়, হােনায়েনের যুদ্ধ (আনুষঙ্গিক বিষয়) মসজিদুল হারামের প্রবেশের অধিকার, আহলে কিতাব প্রসঙ্গ, জিজিয়ার তাৎপর্য, চান্দ্রমাসের হিসাব, মুশরিকরা অপবিত্র, ইহুদি খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত প্রত্যয় ও উক্তি।
আহবার রােহবানের স্থান এবং ভূমিকা ও যাকাত না দেয়ার ভয়ঙ্কর পরিণতি, তাবুক যুদ্ধ প্রসঙ্গ, দুনিয়ার মােহ, আখিরাতের প্রতি উদাসীনতা, জিহাদ অভিযানে মুনাফিকদের ভূমিকা, সদকা ও যাকাতের ব্যয় খাত, মুনাফিকদের আচরণ ও পরিণাম, অতীত জাতির ইতিহাস ও শিক্ষা, মুনাফিকদের অকথ্য উক্তি, মুনাফিকদের জানাযা ও মাগফেরাত প্রসঙ্গ, রুগ্ন, অক্ষম অপারগদের জিহাদ বিরতিতে অপরাধ নেই মুনাফিকদের প্রকৃত রূপ ও রহস্য প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম জান্নাতী ও আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত, যাকাত আদায় ও দোয়া, মুশরিকদের জন্য ইস্তিগফার প্রসঙ্গ, আল্লাহর তাকওয়া এবং দীন ইসলামের প্রসঙ্গ এবং জিহাদ অভিযানে জাতীয় কর্তব্য। সূরা অবতরণ কালে মুনাফিকদের আচরণ এবং রাসূলুল্লাহর গুণ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি।
Leave a Reply