রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৩

হযরত খাদিজা (রা.)

আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘হযরত খাদিজা (রা.)’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।

হযরত খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুতে রাসুল (সা.) খুবই ভেঙ্গে পড়েন। সব সময় তিনি ভারাক্রান্ত মনে দিন যাপন করতেন। এই অবস্থা দেখে নবীজির আত্মীয়-স্বজন খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই সময় হজরত উসমান ইবনে মাযউন (রা.) এর স্ত্রী হযরত

খাওলা বিনতে হাকীম (রা.) নবীজির খেদমতে হাজির হন।

রাসুল (সা.) হযরত খাদিজা (রা.) এর বিয়োগে অত্যন্ত ব্যথিত ছিলেন। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হযরত খাওলা বিনতে হাকীম (রা.) নবীজিকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরামর্শ দেন। হযরত খাদিজা (রা.) সংসারের যাবতীয় কাজ ও ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনা করতেন। সুখে-দুঃখে সকল কাজে রাসুল (সা.) এর সহযোগিতা করতেন। তাই হযরত খাদিজা ( রা.) এর ইন্তেকালে সংসারটা যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো।

এদিকে ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনা করার মতো কেউ নেই। তাই হুজুর (সা.) সম্মতি দিলেন। প্রিয় নবীর সম্মতি পেয়ে হযরত খাওলা বিনতে হাকীম হযরত সাওদা (রা.) এর পিতার কাছে গিয়ে জানালেন, তিনি নবীজির সঙ্গে হযরত সাওদা (রা.) এর বিয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছেন। সব কথা শুনে সাওদার পিতা খুশি হলেন।

কারণ, রাসুল (সা.) শুধু নিজেই শ্রেষ্ঠ মানুষ, শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর ছিলেন না বরং তার বংশও ছিলো আরবের শ্রেষ্ঠ বংশ। তিনি কন্যার মতামত নিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। বিবাহের পূর্বের কাজ ঠিক হলে নবুয়তের দশম বছর শাওয়াল মাসে নবীজির সঙ্গে হযরত সাওদা (রা.) এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিয়ে চারশত দিরহাম মোহরানা ধার্য করে বিবাহ কার্য শেষ হয়।

বংশ পরিচয়
মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনু আমর ইবনে লুই গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কুরাইশ বংশের যামআ ইবনে কায়স আর মদিনার বিখ্যাত নাজ্জার গোত্রের শামুস বিনেত কায়স ছিলেন তাঁর মা। হযরত সাওদা বিনতে যামআ ছিলেন সম্পর্কে প্রিয়নবির আত্মীয়। প্রিয়নবির দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মা সালমা বিনতে আমর এবং সাওদার নানা কায়স ইবনে আমর ছিলেন আপন ভাই-বোন।

সাওদার প্রথম বিয়ে
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বিয়ের আগে হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহার একটি বিয়ে হয়েছিল। তাঁর চাচাতো ভাই সাকরান ইবনে আমর ছিল প্রথম স্বামী। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় অবস্থান কালেই সাকরান ইবনে আমর ৫ মতান্তরে ৬টি ছেলে মেয়ে রেখে ইন্তেকাল করেন।

সাওদার স্বপ্ন প্রথম স্বামী সাকরান ইবনে আমরের মৃত্যুর আগে হযরত সাওদা রাদিয়ালুল্লাহ আনহা দু’টি স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দুটি ছিল এমন-

– হযরত সাওদা একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে একখানি পা তাঁর কাঁধে রাখলেন। তিনি স্বপ্নের কথা তাঁর স্বামীকে জানালে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তুমি যদি এ স্বপ্ন দেখে থাক তাহলে আমার মৃত্যু হবে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে।

– দ্বিতীয় স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন। হঠাৎ তার ওপর আকাশ থেকে চাঁদ ভেঙে পড়ে। স্বামী এ স্বপ্নের কথা শুনে বলেন, খুব শিগগিরই আমি মারা যাচ্ছি। আর আমার মৃত্যুর পর তোমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে। সেই দিনই হযরত সাওদার প্রথম স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অল্প কিছুদিন পর মারা যান।

খাদিজার মৃত্যু ও সাওদার বিয়ে
নবুয়তের দশম বছর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তানদের জননী এবং গৃহকর্ত্রী হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন। এ সময় সন্তান ও ঘর সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে তিনি পৌত্তলিকদের উৎপাতও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় সাহাবাদের অস্থিরতা বেড়ে যায়।

হযরত উসমান ইবনে মাজউন রাদিয়াল্লাহু আনহু স্ত্রী হযরত খাওলা বিনতে হাকিম রাদিয়াল্লাহু আনহা একদিন প্রিয়নবির কাছে গেলেন এবং নানান কথার ফাঁকে তিনি প্রিয়নবিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন যে, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আবার বিয়ে করুন।

প্রিয়নবি জানতে চাইলেন পাত্রী কে? খাওলা বললেন, বিধবা এবং কুমারি; দুই ধরনের পাত্রীই আছে। আপনি যাকে পছন্দ করেন, তার ব্যাপারেই প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে।
প্রিয়নবি আবার জানতে চাইলেন পাত্রী কে?

তখন খাওলা বললনে- বিধবা পাত্রী হলো হযরত সাওদা বিনতে যামআ এবং কুমারি পাত্রী হলেন, হযরত আবু বকরের মেয়ে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা।

তখন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইঙ্গিতসূচক মন্তব্য করলেন যে, এ (বিয়ের) ব্যাপারে ভূমিকা পালনে মেয়েরাই অধিকতর যোগ্য।

অতঃপর হযরত খাওলা রাদিয়াল্লাহু আনহা উভয় পরিবারের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান। হযরত সাওদার পিতা এ প্রস্তাবকে উত্তম বলে ঘোষণা দেন এবং নিজে অভিভাবক হয়ে বিশ্বনবির কাছে হযরত সাওদাকে বিয়ে দেন।

নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক বিশেষ সময়ে হযরত সাওদার সঙ্গে বিয়ে হয়। যখন তিনি খুবই সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে জীবনাতিপাত করছিলেন। হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংসারে হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন করেন।

এভাবে প্রিয়নবির সঙ্গে অন্য কোনো স্ত্রী ছাড়াই হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহু ৩ বছর অতিক্রম করেন। হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহাসহ তখনও প্রিয়নবির সংসারের সদস্য ছিলেন হযরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু। এ সব কিছুর যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

সাওদার উদারতা ও দূরদর্শীতা
হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অনেক দূরদর্শী মহিয়সী নারী। তিনি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মানসিকতা আঁচ করতে পারতেন। তিনি তার জন্য নির্ধারিত রাতটি হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহুর সঙ্গে যাপনের জন্য দান করে দিতেন।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য হজরত সাওদার হৃদয় ছিল ভালোবাসা ও আনুগত্যে পরিপূর্ণ। এছাড়াও হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহু অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সম্পর্কে বলেন-‘পৃথিবীতে একমাত্র সাওদাকে দেখলেই আমার ঈর্ষা হত; আমি যদি তাঁর মতো হতে পারতাম।’

সাওদার দানশীলতা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আখলাক ও স্বভাব-চরিত্রের এক অনুপম দিক ছিল দানশীলতা। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থাকার ফলে হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহা অধিক দানের অভ্যাস গঠন করে ফেলেছিলেন।

তিনি অনেক দান করতেন। তাঁর কাছে দান করার মতো কোনো কিছু থাকলে তিনি কখনোই কোনো সাহায্য প্রার্থীকে খালি হাতে ফেরত দিতেন না।
একবার খলিফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে একটি থলি পাঠান। তিনি থলি বহনকারীকে প্রশ্ন করলেন, থলিতে কী? বহনকারী বলল, ‘দিরহাম’। ‘থলিতে খেজুরের মত দিরহাম পাঠানো হয়’- এ কথা বলে তিনি সবগুলো দেরহাম তখুনি মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দেন।

প্রিয়নবির নির্দেশ পালন
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের মধ্যে হযরত সাওদা আল্লাহর রাসুলের সব নির্দেশ পালনে একনিষ্ঠ ছিলেন। হযরত সাওদার পাশাপাশি হযরত জয়নাব বিনতে জাহাশও প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পালনে কঠোর ছিলেন।

বিদায় হজের ভাষণে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবিত স্ত্রী ‘উম্মাহাতুল মুমিনিন’ (ঈমানদারদের মা)-এর বলেছিলেন, ‘আমার (ওফাতের) পরে তোমরা ঘরে অবস্থান করবে।’
যে কারণে হযরত সাওদা বিনতে যামআ এবং হযরত জয়নাব বিনতে জাহাশ প্রিয়নবির এ কথার ওপর আমল করতে গিয়ে আর কখনো হজ ও ওমরায় অংশগ্রহণ করেননি।

ইন্তেকাল
হযরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত সাওদা বিনতে যামআ রাদিয়াল্লাহু আনহা ৫৪ হিজরির শাওয়াল মাসে ইন্তেকাল করেন। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি ৫৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। অনেকেই বলেছেন যে, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হযরত সাওদা বিনতে যামআ রাদিয়াল্লাহু আনহার জানাযায় ইমামতি করেন।

শিক্ষা লাভ
নারীদের জন্য হযরত সাওদা হলেন ত্যাগ ও ধৈর্যের অনুপম দৃষ্টান্ত। হযরত সাওদা বিনতে যামআ ‘আত্মত্যাগ’-ই নারীদের জন্য অন্যতম শিক্ষা। নিজের স্বার্থকে ছোট করে দেখা অন্যকে প্রাধান্য দেয়া। বিশেষ করে যেসব নারীদের একাধিক সতীন থাকে তারা বয়সভেদে একে অপরকে প্রাধান্য দেবে।

যেভাবে হযরত সাওদা বিনতে যামআ রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজের অধিকারের রাতগুলো প্রিয়নবিকে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্য ছাড় দিয়েছেন।

আবার একে অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে না বেরিয়ে অন্যকে সাহায্য করার গুণও অর্জন করতে পারেন। অন্যের নির্লোভ প্রশংসা করার গুণও অর্জন করা যেতে পারে।

আল্লাহ তাআলা বর্তমান সময়ে নারীদেরকে হজরত সাওদা রাদিয়াল্লাহু আনহার গুণে গুণাম্বিত হওয়ার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সংসার ও সমাজ বিনির্মানের তাওফিক দান করুন।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024