শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪৬

যাইনাব বিনতে জাহাশ রা.

যাইনাব বিনতে জাহাশ রা.

আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘যাইনাব বিনতে জাহাশ রা.’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।

زينب بنت خزيمة উম্মু আল মিসকিন , “গরীবদের মা” হিসাবে পরিচিত, জন্ম ৫৯৫ আরবের সুলাইম গোত্রের মেয়ে। তার প্রথম স্বামীর নাম আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ। তিনি তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসের ৭ তারিখে সংঘটিত উহুদের যুদ্ধে শহিদ হলে আল্লার রাসুল রাসুল সঃ জয়নবকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। জয়নব প্রস্তাবে সম্মত হলে মোহাম্মদ সঃ তাকে চারশত দিরহাম মোহরানা দিয়ে এ বছরই জিলহজ্ব  মাসের শেষ দিকে বিয়ে করেন।

জয়নব বিনতে খোজায়মা (রা.)। পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্ণিমার মতো উজ্জ্বল এক নাম। নবীজির প্রিয়তমা স্ত্রী। বংশপরম্পরা জয়নব বিনতে খোজায়মা ইবনে হারেস ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আবদে মানাফ। উপাধি উম্মুল মাসাকিন। বাবা খোজাইমা ইবনে হারেস। মা হিন্দ বিনতে আওফ।

তার বংশপরম্পরা নবী (সা.) এর ২১তম পূর্বপুরুষে গিয়ে মাআদ ইবনে আদনানের সঙ্গে মিলে যায়। সম্পর্কে তিনি নবীজির (সা.) অপর স্ত্রী মায়মুনা বিনতে হারেসের (রা.) বৈপিত্রীয় বোন। চরিতাভিধান আল-ইসাবায় বলা হয়েছে, মায়মুনা (রা.) ও তার বোনের মা হিন্দ বিনতে আওফের ঘর থেকে অধিক আভিজাত্যপূর্ণ ঘর আরবে দেখা যায়নি।

তিনি নবুয়তের ১৩ বছর আগে মক্কা মুকাররমায় সম্ভ্রান্ত কোরাইশ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। নবী ইসমাঈল (আ.) এর সন্তানাদির মধ্যে একটি বড় গোত্র ছিল বনু আমের নামে। বনু আমেরের একটা শাখা ছিল বনু হেলাল। বনু হেলাল ছিল ইয়েমেন দেশের। তারা একটা পর্যায়ে ইয়েমেন ছেড়ে হেজাযে চলে আসেন।

এ হেজাযেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই বেড়ে ওঠেন। এ সময় অনেক ফেতনা-ফ্যাসাদে ভরে ছিল হেজাযের মক্কা নগরী। মূর্তিপূজা ছিল ব্যাপক। বৃক্ষপূজা, পাথরপূজা ছিল তাদের উদ্দীপনার বিষয়। এমন একটা পরিবেশেই তিনি চোখ খোলেন।

সে সময় কন্যাসন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়া ছিল সম্মানের। কিন্তু যেহেতু তিনি অনেক উঁচু খান্দানের ছিলেন। এজন্য আল্লাহর রহমতে এ ভয়ানক মৃত্যু থেকে বেঁচে যান। বাবা-মার ভালোবাসা বেড়ে যায় তার প্রতি। সে সময় মক্কার অভ্যন্তরে কাবার পুনর্নির্মাণ এবং হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।

শৈশবকাল:
বাবা খোজায়মা ছিলেন আরবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য জয়নবের বাল্যকাল বেশ বিলাসিতায় কেটেছে। এ সত্ত্বেও তার কিছু বৈশিষ্ট্য এমন ছিল, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়।

উম্মুল মাসাকিন উপাধি:
তিনি অনেক উঁচু আখলাকসম্পন্ন ছিলেন। বদান্যতা, দানশীলতা, মহব্বত-ভালোবাসার গুণে ছিলেন গুণান্বিত। তিনি অসহায়দের প্রতি ছিলেন খুব যতœবান। তাদের খাবার খাওয়াতেন। অন্যান্য প্রয়োজন পুরা করতেন।

এজন্য জাহেলি যুগ থেকেই লোকেরা তাকে উম্মুল মাসাকিন উপাধি দিয়েছে। আবদুল মালেক ইবনে হিশাম বসরি লিখেছেন, ‘জয়নবের নাম উম্মুল মাসাকিন (অসহায়দের মা) ছিল, কেননা তিনি অভাবীদের জন্য দয়াদ্র ছিলেন।’ (ইবনে হিশাম : ৪/২৯৬)।

ইমাম ইবনে শিহাব জুহরি (রহ.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) জয়নবকে (রা.) বিয়ে করেছেন, যাকে উম্মুল মাসাকিন বলা হতো। এ নাম এজন্য বলা হয় যে, তিনি মিসকিনদের অনেক খাবার খাওয়াতেন। তিনি ছিলেন বনু আমের ইবনে সা’সাআ গোত্রের।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৯/২৪৮)।

আল ইসাবায় রয়েছে, ‘তাকে উম্মুল মাসাকিন বলা হতো, কেননা তিনি তাদের খাবার খাওয়াতেন এবং তাদের দান-সদকা করতেন।’ (তারিখুত তাবারি : ৩/৩৩)। কোনো কোনো মনীষী উম্মুল মাসাকিন উপাধি জয়নব বিনতে জাহাশকে (রা.) দিয়েছেন। কিন্তু কথাটি সহিহ নয়। সহিহ সেটাই, যা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসলাম গ্রহণ:
যেহেতু তার জন্ম নবুয়তের ১৩ বছর আগে, তাই নবুয়তের ঘোষণার কিছুকাল পরেই যারা মুসলমান হয়েছেন তিনি তাদের অন্যতম।

বিয়ে ও হিজরত:
ইতিহাসবিদরা লিখেছেন, তার প্রথম বিয়ে হয় তোফাইল ইবনে হারেসের সঙ্গে। বিয়ের কিছুকাল পরেই বনিবনা না হওয়ায় তোফাইল তাকে তালাক দেন। দ্বিতীয় বিয়ে হয় তোফাইলেরই ভাই আবু মোয়াবিয়া ওবায়দা ইবনে হারেসের (রা.) সঙ্গে। মক্কায় কাফেরদের জুলুম-নির্যাতন বেড়ে গেলে নবী (সা.) মুসলমানদের মদিনায় হিজরত করতে নির্দেশ করেন।

ফলে তারা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের পর নবী (সা.) ওমায়ের ইবনে হামাম আনসারিকে (রা.) তার স্বামী ওবায়দার (রা.) ভাই বানিয়ে দিলেন। ওমায়ের (রা.) ওবায়দা (রা.) ও তার খান্দানের জন্য একটি বাড়ি এবং পর্যাপ্ত জমি ওয়াকফ করে দেন।

মুহাজির-আনরসাররা ওবায়দাকে (রা.) ‘শায়খুল মুহাজেরিন’ উপাধিতে স্মরণ করতেন। মক্কা নগরীর মতো জয়নব এখানেও অনেক দান-দাক্ষিণ্য করতেন। এরই মধ্যে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ গাযওয়ায়ে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

স্বামী ওবায়দা বদরের মল্লযুদ্ধপর্বে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। হাফেজ ইবনে সায়্যিদুন নাসের মত এটাই। জয়নবের তৃতীয় বিয়ে হয় উম্মুল মোমিনিন জয়নব বিনতে জাহাশের (রা.) ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের (রা.) সঙ্গে। এ স্বামীও উহুদ যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন।

আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে শহীদ হন। তার শাহাদাতের কিছুদিন পর জয়নবের (রা.) একটি অপূর্ণাঙ্গ বাচ্চা হয়। ফলে অল্প সময়ে তার ইদ্দত শেষ হয়ে যায়।

এরপর তৃতীয় হিজরির পবিত্র রমজান মাসে মহানবী (সা.) জয়নবের (রা.) মনোরঞ্জনের জন্য তাকে বিয়ে করেন। আর জয়নব লাভ করেন পঞ্চম উম্মুল মোমিনের মর্যাদা। বিয়েতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন জয়নবের (রা.) চাচা কাবিসা ইবনে আমর হেলালি। নবী (সা.) ১২ উকিয়া দেনমোহর আদায় করে দেন।

নবীজির সঙ্গলাভ:
রাসুলের (সা.) সঙ্গে তার বেশিদিন সংসার করার সুযোগ হয়নি। বিয়ের কিছুদিন পরই তিনি পরজগতে পাড়ি জমান। সংসার করার সময়ের ব্যাপারে ২, ৩, ৫ ও ৬ মাস ইত্যাদি বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। ইবনে কালবি (রহ.) বলেন, তৃতীয় হিজরির রমজানে বিয়ে হয়েছে। নবীজির বিয়েবন্ধনে আট মাস থাকেন। অতঃপর চতুর্থ হিজরির রবিউসসানি মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন। (উসদুল গাবাহ)।

মর্যাদা:
তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বামী ওবায়দা বিনতে হারেসের শাহাদতবরণ করার সংবাদ শুনেও ভেঙে পড়েননি; বরং আহত মুজাহিদদের পানি পান করানো এবং তাদের মলম-পট্টি বাঁধার কাজেই রত ছিলেন। এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

সিরাতে ইবনে ইসহাকে রয়েছে, উম্মুল মোমিনিনরা রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, (জান্নাতে) সর্বপ্রথম আপনার সঙ্গে কে মিলিত হবে? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, যার হাত লম্বা হবে। তাই উম্মুল মোমিনিনদের মধ্যে তর্ক হলো হাত কার লম্বা। কিন্তু জয়নবের (রা.) ইন্তেকাল হওয়ার পর স্পষ্ট হয় যে, দান-সদকায় তার হাত ছিল সবচেয়ে লম্বা।

গরিব-অসহায় মানুষের পাশে যারা দাঁড়ায় পবিত্র কোরআনেও তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহর মহব্বতে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে খাবার দান করে। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর : ৮ ও ৯)।

তিনি ছিলেন অনেক উঁচু খান্দানের মানুষ। রত্নগর্ভা মা হিন্দ বিনতে আওফ ধারণ করেছেন আরও বেশ ক’জন পুণ্যবান কন্যা। কন্যারা হলেন-

১. উম্মুল মোমিনন মায়মুনা বিনতে হারেস হিলালিয়্যা (রা.),

২. আসমা বিনতে উমাইস (রা.) [যিনি আবু বকর সিদ্দিক (রা.), জাফর (রা.) ও আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) এর স্ত্রী],

৩. আরওয়া বিনতে উমাউস রা. [যিনি হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.) এর স্ত্রী],

৪. উম্মুল ফজল লুবাবা কোবরা বিনতে হারেস হিলালিয়্যা (যিনি আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী),

৫. লুবাবা সুগরা বিনতে হারেস হিলালিয়্যা [খালেদ ইবনে ওয়ালিদের (রা.) মা]।

মৃত্যু:  
শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভি (রহ.) লিখেছেন, জয়নব (রা.) চতুর্থ হিজরির রবিউস সানি মাসে ইন্তেকাল করেন। মুহাম্মদ ইবনে ওয়াকিদি (রহ.) (২০৭ হি.) এর মতে মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৩০ বছর।

হাদিস শাস্ত্রের অমর ভাষ্যকার আল্লামা ইবনে হাজার (রহ.)ও এমনটি উল্লেখ করেছেন। তার জানাজার ইমামতি করেছেন স্বয়ং রাসুল (সা.)। মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাকে দাফন করা হয়। নবীপতীদের মধ্যে জান্নাতুল বাকিতে সর্বপ্রথম তাকেই দাফন করা হয়।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024