ফুরোলে ১৪২০ সাল, আরেকটি নতুন সূর্যের প্রত্যাশা এখন বাংলাদেশ জুড়ে। সবার প্রত্যাশা নিয়ে বসন্তের শেষ দিন রোববার রাত পোহালেই প্রথম সূর্যের হাত ধরে আসবে নতুন বাংলা বছর ১৪২১। চৈত্রসংক্রান্তির নানা আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪২০ সালকে বিদায় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নতুন বছরকে বরণের প্রস্তুতি।
বাংলা নতুন বছরে পুরনো সব জীর্ণতা মুছে যাবে- সবার এই প্রত্যাশার সহযাত্রী হলেন রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদও। ফেলে আসা বছরের সব তমসা দূর হয়ে অনাবিল আলোয় স্নাত হবে আমাদের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক ভবিষ্যৎ, এ প্রত্যাশা করি, নববর্ষের বাণীতে বলেছেন তিনি।
দেড় সহস্র বছর আগে আকবরি আমলে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য যে সালের প্রবর্তন হয়েছিল, তা এখন বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। গত শতকের ষাটের দশকে বর্ষবরণের এই উৎসব যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তার সুর ধ্বনিত হয়েছে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বাণীতে। পহেলা বৈশাখ সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
গত বছরের রাজনৈতিক সংঘাত পেরিয়ে নতুন বছর ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা ঝরেছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বাণীতে। আমরা নানা ঘটনা ও দুর্ঘটনার সাক্ষী ১৪২০ সালের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ১৪২১ সালের দরজায় উপস্থিত হয়েছি। এই নববর্ষে সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় নিক অসত্য, অন্যায়, অনাচার ও অশান্তি।
প্রতিবছরের মতো এবারো রাজধানীতে বর্ষবরণের মূল আয়োজন রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রায় চার দশকের নিয়মিত অনুষ্ঠানটি। ছায়ানটের এ প্রভাতী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এক যুগের বেশি সময় আগে বোমাহামলার বেদনাদায়ক সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এবারো রমনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা থাকবে, তার মহড়াও ইতোমধ্যে হয়েছে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের নিয়মিত বর্ণিল আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা’র প্রস্তুতিও প্রায় শেষ।
নির্বাচন পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটে এবার শোভাযাত্রায় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দুঃসময়ের কাণ্ডারির প্রতীক হিসেবে ‘গাজী ও বাঘ’ থাকছে মঙ্গল শোভাযাত্রায়। সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে লক্ষ্মীপেঁচা, শিশু হরিণ, মা ও শিশু, হাঁস ও মাছের ঝাঁক, লোক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিড়ালের মুখে চিংড়ি, শখের হাঁড়ি তুলে ধরা হবে।
এছাড়া বাঘের দুটি বড় মুখোশ, ময়ূর, ১০টা ছোট পাখি, প্রায় এক হাজার কাগজের ছোট মুখোশ, ১০০টি বড় মুখোশও শোভাযাত্রায় স্থান পাবে। শাহবাগে ঢাকা শিশু পার্কের সামনে এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরেও অনুষ্ঠান থাকছে বরাবরের মতোই। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে। বিভাগীয় শহর এবং ৫৭টি জেলা ও সব উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ আলোচনা সভা ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন।
শিল্পকলা একাডেমি করবে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটগুলো ও বিসিক নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আয়োজন করবে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা।
ইতিহাস বলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের যুগে প্রবর্তন হয়েছিল বাংলা সালের। ষোড়ক শতকে আকবর ‘ফসলী সন’ প্রবর্তনের মাধ্যমে যে বাংলা সাল চালু করেছিলেন সময়ের বিবর্তনে সেই দিনটি এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব পরিণত হয়েছে। আকবরের নবরত্নসভার আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য হিজরি চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে ফসলি সালের গণনা শুরু করেছিলেন। তিনিই হিজরিকে বাংলা সালের সঙ্গে সমন্বয় করে বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন। বৈশাখ নামটি নেওয়া হয়েছিল নক্ষত্র ‘বিশাখা’ থেকে।