শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ১২:৩৩

রক্তাক্ত বাংলাদেশ শীর্ষক ফটো অ্যালবামের প্রকাশনায় প্রধানমন্ত্রী

রক্তাক্ত বাংলাদেশ শীর্ষক ফটো অ্যালবামের প্রকাশনায় প্রধানমন্ত্রী

দুই বছর আগের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর দেশজুড়ে জামায়াতে ইসলামীর তাণ্ডবে অন্ধকার নেমে এসেছিল হযরত আলীর পরিবারেও। ‘বিএনপি-জামাতের তাণ্ডব : রক্তাক্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক ফটো অ্যালবামের প্রকাশনা উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
সেটা কেমন ছিল, তা ফুটে উঠল এই পুলিশ কনস্টেবলের স্ত্রীর কথায়- আমার একটাই সন্তান। জীবনে সে বাবা ডাক হারিয়ে ফেলেছে। আমি এখন কার কাছে যাব? ওসমানী মিলনায়তনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই কথাটি বলে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন লায়লা খাতুন।

অনুষ্ঠানে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যরাও তখন উঠে দাঁড়ান। ধরাধরি করে তোলা হয় লায়লাকে। এরপর বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় লায়লাকে, দর্শক সারি থেকে উঠে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকও সেখানে যান শুশ্রূষার জন্য। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসে লায়লার। শনিবার ওসমানী মিলনায়তনে ছিলেন লায়লার মতোই অর্ধ শতাধিক নারী-পুরুষ, গত বছরজুড়ে তাণ্ডবে যাদের কেউ হারিয়েছেন স্বজন, কেউ আবার নিজেরাই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। 

যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং নির্বাচন ঠেকাতে গত বছরজুড়ে সহিংস আন্দোলনের চিত্র নিয়ে এই অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন করতে উপস্থিত শেখ হাসিনাকে সহিংসতার শিকারদের বর্ণনা শুনতে শুনতে এক সময় চোখ মুছতেও দেখা যায়। সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বক্তব্যে বলেন, আর, আমরা এই ধরনের ঘটনা দেখতে চাই না। আর, এ ধরনের অবস্থা যেন বাংলাদেশে না ঘটে। সেটাই আমার আবেদন থাকবে দেশবাসীর প্রতি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বক্তব্যের আগে লায়লা খাতুনসহ আটজন তাদের কথা বলেন। গাইবান্ধার বামনডাঙায় পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে কিভাবে হযরত আলীসহ কনস্টেবলদের হত্যা করা হয়েছিল, তার বর্ণনা লাইলি দেয়ার সময় মিলনায়তনে ছিল পিনপতন নীরবতা।

শাড়ীর আচঁলে চোখ মুছতে মুছতেই সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যান স্বামীহারা এই নারী। আমার স্বামী ফাঁড়িতে ডিউটি করছিল… আমি কী বলব, কান্নায় ভেঙে পড়ার পর এক নাগাড়ে বলতে থাকেন, মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমার স্বামী আমাকে ফোন করেছিলেন, বলেছিলেন- একটা মিছিল আসছে, গণ্ডগোল হচ্ছে। এরপর আমি ফোন করি। আর, ফোন ধরে না। পরে একজন ফোন ধরে বলে, তিনজন পুলিশ মারা গেছে। আমি ছুটে যাই। ওরা আমার স্বামীকে এমনভাবে হত্যা করেছে, লাশ দেখে প্রথমে আমার স্বামীকে চিনতে পারিনি। ব্যাজে নাম দেখে চিনেছি।

২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামীর কর্মসূচির দিন ঢাকা পশ্চিম ট্রাফিক পুলিশ কার্যালয়ে কর্মরত কনস্টেবল পিয়ারুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন তার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা বলতে। পিয়ারুলের শরীরের ৮০ ভাগ আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন প্রধানমন্ত্রী।

পিয়ারুল বলেন, সেদিন ৩টা ১০ মিনিটে হাজার হাজার লোক গানপাউডার দিয়ে অফিস জ্বালিয়ে দেয়। নিচে গাড়িতে পেট্রোল দিয়ে আগুন দেয়। নিজের দুই অগ্নিদগ্ধ হাত তুলে এই পুলিশ সদস্য বলেন, আমার দুই হাতের চামড়া গলে গলে পড়ছিল। এক সময় দেখি আমার শরীর থেকে সব তেলের মতো বের হচ্ছে। সেই যন্ত্রণার কথা ভোলার নয়। পিয়ারুল তার পিঠের কাপড় তুলে ক্ষতবিক্ষত চামড়া দেখিয়ে বলেন, আমার এই অবস্থা যারা করেছে, তাদের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী এসময় কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছছিলেন। ছাত্রলীগকর্মী হেলালউদ্দিন পিয়ারু ছিলেন অনুষ্ঠানে, এখনো তিনি ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারেন না। তার শ্বাসনালীতে প্লাস্টিকের পাইপ বসাতে হয়েছে।

PM_3_23.08.2014_Kallol.png২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ফটিকছড়ির ভুজপুরে হরতালবিরোধী মিছিলে জামায়াত-শিবিরের হামলায় মারাত্মক আহত হন পিয়ারু। মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্বাস টেনে টেনেই পিয়ারু তার ওপর হামলার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। মসজিদের মাইক থেকে বলা হয় যে, আমরা মসজিদ আর মাদ্রাসায় হামলা করেছি। মাওলানাকে হত্যা করেছি। আমাকে ১৮টা কোপ দেয়। আমার গলা ছুরি দিয়ে কেটে দেয়।

নিজের ক্ষতবিক্ষত পেট দেখিয়ে তিনি বলেন, আমার নাড়ি-ভুড়ি বের করে দেয়। আমার অপরাধ কী? আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করি, আমি শেখ হাসিনার কর্মী- এটাই আমার অপরাধ? পিয়ারুর ওপর হামলার নৃশংসতার বর্ণনা শুনে প্রধানমন্ত্রী নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেন।

ছেলে হারানোর বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক ঘটনার কথা বলেন ভ্যানচালক রহমত আলী। যে ভ্যান চালাতেন রহমত আলী, সেই ভ্যানেই পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারলে অগ্নিদগ্ধ হয় তার ছেলে মনির। চারদিন পর মারা যায় সে। রহমত আলী কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, “আমার এখানে কিছু বলার নেই। আমার সামনে আমার ছেলে ৯০ ভাগ পুড়ে যায়। আমি ১০ মাস ধরে কেনো কাজ করতে পারছি না। আমি দ্রুত বিচার চাই। কেউ যেনো আমার মতো সন্তান না হারায়। কথা শেষে প্রধানমন্ত্রীর পেছন দিয়ে নিজের জন্য নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার সময় শেখ হাসিনা হাত ধরে রহমত আলীকে সান্ত্বনা দেন।

PM_21_23.08.2014_Kallol.pngমঞ্চের পেছনে দু’দিকে কোণাকুনিভাবে সিঁড়ির মতো তিনটি ধাপে অগ্নিদগ্ধ, সন্তানহারা অভিভাবক, স্বামীহারা বিধবা স্ত্রী এবং ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক আহতরা বসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার আগে আক্রান্ত সবার সঙ্গে কথা বলেন, সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অনেককে জড়িয়েও ধরেন তিনি।

২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর বিএনপি-জামায়তের কর্মসূচি চলাকালে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৯জন যাত্রীর সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ আইনজীবী খোদেজা নাসরিনও ছিলেন অনুষ্ঠানে। এই আইনজীবী এখন তার ডান মুষ্টিবদ্ধ করতে পারেন না। অগ্নিদগ্ধ হয়ে তার হাতের পেশি আর চামড়া শক্ত হয়ে গেছে। আপনারা হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে পারেন। কিন্তু, আমি পারি না। এই যন্ত্রণা থেকে মরে যাওয়াই ভাল ছিল বলে মাঝে মাঝে মনে হয়,” ডান হাত শূন্যে তুলে বলেন এই আইনজীবী।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধার কুন্তাইল কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সহযোগী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম আগুনে পুড়ে যাওয়া তার দুই হাত দেখিয়ে বলেন, “আমার ওপর হামলার কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার মুখের ওপর পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে। আমি হাত দিয়ে ঠেকাই। তখন পুরো শরীরে আগুন লেগে যায়। সাইদুল ইসলাম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, অনেকেই আগুন লাগার পর আমাকে আশ্রয় দিতে চায় নাই। তারা আমাকে বলেছে, আমাকে আশ্রয় দিলে তাদের বাড়ি ভেঙে দেবে।

মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি চলাকালে বায়তুল মোকাররমের নিচে ফুটপাতে ধর্ম গ্রন্থের পুস্তকের দোকানে আগুন দেয়ার ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে মিজানুল করিম বলেন, আমি নিজে চোক্ষে দেখছি, কিভাবে কোরআন শরিফে আগুন দিসে। এরা কী মানুষ, না ফেরাউনের গ্রুপ?




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025