বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ০৬:৪৫

দল থেকেও বহিষ্কার লতিফ: বহিষ্কার না করার অনুরোধ করেছিলেন

দল থেকেও বহিষ্কার লতিফ: বহিষ্কার না করার অনুরোধ করেছিলেন

শীর্ষবিন্দু নিউজ ডেস্ক: হজ নিয়ে মন্তব্যের পর মন্ত্রিত্ব ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর পদ হারানো আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করে তাকে আওয়ামী লীগ থেকেও চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

তিনি বলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তিনি যে জবাব দিয়েছেন তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তার প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দলে আপিল করার সুযোগ পাবেন না বলেও জানান আওয়ামী লীগের মুখপাত্র।

আওয়ামী লীগের সদস্যপদ যাতে বহাল থাকে সে জন্য দলের কাছে অনুরোধ করেছিলেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। কিন্তু ধর্ম নিয়ে তার মন্তব্য করা ক্ষমার অযোগ্য বিবেচনা করে আওয়ামমী লীগ তাকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করেছে। শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকাররি বাসভবন গণভবনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

দল থেকে বাদ পড়ায় লতিফের সংসদ সদস্যপদ থাকছে কি-না এমন প্রশ্নে আশরাফ বলেন, আমরা আমাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ইসিতে পাঠিয়ে দেব। সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ অবশ্য এর আগে জানিয়েছিলেন, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ফ্লোর ক্রসিংয়ে না পড়ায় লতিফ সিদ্দিকী দল থেকে বাদ পড়লেও সাংসদ পদে থাকছেন।

সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের কয়েক জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দল থেকে কারণ দর্শানো নোটিশের দীর্ঘ ২২ পৃষ্ঠার লিখিত জবাব দিয়েছেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। তার দেয়া জবাবের মূল অংশ হিসেবে ৪/৫ পৃষ্ঠা সভায় পড়ে শোনানো হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জবাবের কপি থেকে পড়ে শোনান।

নোটিশের জবাবে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ধর্ম নিয়ে নিউইয়র্কে তার দেয়া বক্তব্যের পক্ষেই তিনি অবস্থান নেন। লিখিত জবাবে লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, প্রতিটি মানুষেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সত্যই সুন্দর। জবাবে তিনি তার দীর্ঘ দিনের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে থাকার কথা তুলে ধরেছেন। তাকে মন্ত্রী সভা থেকে অপসারণ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে-এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে তিনি দলের প্রাথমিক সদস্য পদ বহাল রাখার অনুরোধ জানান। জবাবে মানবিক দিক বিবেচনা করে তার সদস্যপদ বহাল রাখার অনুরোধ করেছেন। তার বক্তব্যে বিব্রত হওয়ার জন্য তিনি দলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তবে বক্তব্যের জন্য তিনি ক্ষমা চাননি।

সূত্র জানায়, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সভায় লতিফ সিদ্দিকীর জবাবেরর অংশ বিশেষ পড়ে শোনানোর পর তার বিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরেন। সৈয়দ আশরাফ বলেন, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনী মোশতাক সরকারকে লতিফ সিদ্দিকী সমর্থন দিয়েছিলেন। এরশাদের সামরিক সরকারের সময় সংবিধান সংশোধনীতে তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী ভোট দিয়েছিলেন। এখন তিনি ধর্ম নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তার সদস্য পদ থাকবে কি-না সে ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আশরাফের বক্তব্যের পর একে একে নেতারা তাদের মতামত ব্যাক্ত করেন। ২০/২২ জন নেতা সভায় বক্তব্য দেন। এদের মধ্যে  উল্লেখযোগ্য হলেন, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সুভাষ চন্দ্র, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন প্রমুখ। বক্তাদের প্রত্যেকেই লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কারের পক্ষে মত দেন।

সূত্র জানায়, নেতাদের বক্তব্য শোনার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- তিনি দীর্ঘ আওয়ামী লীগ করেছেন। মন্ত্রী হয়েছেন, আওয়ামী লীগের সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন। তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তাকে আর আওয়ামী লীগ চায় না। সে যে কাজ করেছে কোনোভাবেই তাকে ক্ষমা করার সুযোগ নেই। ধর্ম নিয়ে মানুষের মনে আঘাত দিয়ে বক্তব্য আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শের বিরুদ্ধে। এতে তাকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

এর পর সর্বসম্মতিক্রমে লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আগামী দুই এক দিনের মধ্যে তার টাঙ্গাইলের স্থায়ী ঠিকানায় আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেয়া হবে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রবাসে এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে মন্তব্য করার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্টভাষী ও আত্মম্ভরী হিসেবে পরিচিত ৭৭ বছর বয়সী লতিফকে নিয়ে বাংলাদেশে চলছিল তুমুল আলোচনা।

এরপর বিভিন্ন জেলায় এই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা হয়েছে, জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তার গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়ে হরতালও ডেকেছে কয়েকটি ইসলামী দল। এ পরিস্থিতিতে নিজের দলেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে নির্বাচিত চার বারের এই সংসদ সদস্য। গত ১২ অক্টোবর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ওইদিন লতিফ সিদ্দিকীর প্রাথমিক সদস্যপদ স্থগিতেরও সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। তাকে কেন চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হবে না- তা জানতে চেয়ে ১৪ অক্টোবর কারণ দর্শাও নোটিস পাঠানো হয়।

নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে যে বক্তব্য লতিফ সিদ্দিকী করেছেন- তা উল্লেখ করে নোটিসে বলা হয়, আপনার এ বক্তব্য কেবল গর্হিত ও অনভিপ্রেতই নয়, বাংলাদেশ ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি আঘাত স্বরূপ। তা আওয়ামী লীগের নীতিবিরোধী এবং আদর্শ ও গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লংঘন। কলকাতায় অবস্থানরত লতিফ সেখান থেকেই নিজের জবাব পাঠিয়ে দেন, যদিও শেষ রক্ষা হয়নি।

শেষ রক্ষা যে হবে না আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাতেই তার ইংগিত মিলেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, উনি (লতিফ) যেটা বলেছেন তার খেসারত উনাকেই দিতে হবে। শুক্রবার শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হলো।

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা লতিফ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে পাঁচ বছর তা পালন করেন। এবার পেয়েছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই তাকে বিদায় নিতে হয়। লতিফকে সভাপতিমণ্ডলীর পদ থেকে বাদ দেওয়ারে ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের ৪৬ ‘ক’ অনুচ্ছেদের কথা বলেছে আওয়ামী লীগ।

ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলী বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থি কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিলে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ তাহার বিরুদ্ধে যে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। আর তাকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে গঠনতন্ত্রের ৪৬ ‘ঞ’ অনুচ্ছেদ অনুসারে।

এতে বলা হয়েছে, সংগঠনের যে কোনো শাখা তাহার যে কোনো কর্মকর্তা বা সদস্যকে দলের স্বার্থ, আদর্শ, শৃঙ্খলা তথা গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের জন্য স্ব-স্ব পদ বা দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি প্রদান করিতে পারিবে। তবে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন শাখার অনুমোদন প্রয়োজন হইবে এবং এইক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শাখার সাধারণ সভায় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। ঊর্ধ্বতন শাখা পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে তাহার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট শাখাকে জানাইবে, অন্যথায় সিদ্ধান্তের সহিত একমত বলিয়া গণ্য হইবে।

টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের অন্যতম সদস্য আব্দুল কাদের সিদ্দিকী দল ছাড়েন প্রায় দুই দশক আগে, এখন তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও বাদ পড়লেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর লতিফ সিদ্দিকী নিউ ইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে কথা বলেন। নিজেকে অহংকারী উল্লেখ করেই লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাত দুটোর ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীর যতটা বিরোধী, তার চেয়ে বেশি হজ আর তাবলিগের বিরোধী।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025