বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৮:৪০

বরিশালের মেয়ে হল্যান্ডের ছেলে

বরিশালের মেয়ে হল্যান্ডের ছেলে

মো. সাইফুল্লাহ: কনে বাংলাদেশের সম্পা বালা। বর হল্যান্ডের নিল রাকা। হল্যান্ড থেকে বরযাত্রী এল ৩৫ জন। বাঙালি রীতিতে বিয়ে হলো বরিশালের কাউনিয়ায়। এই বিয়ে নিয়েই…

.‘জামাই আসছে! জামাই আসছে! ২৪ নভেম্বর, বরিশালের কাউনিয়া থানার স্বপন বালার বাড়িতে তখন হইচই চলছে। এ বাড়ির মেয়ে সম্পা বালার বিয়ে। শ্যালক-শ্যালিকা, ছোটরা সব একজোট হয়। নগদ ৩০ হাজার টাকা না দিলে জামাইকে ঢুকতেই দেওয়া হবে না!

জামাই নিল রাকা হল্যান্ডের বাসিন্দা। বরপক্ষে আছেন ৩৫ জন ভিনদেশি। তবে এ দেশের বিয়েতে গেট ধরার এই রীতি তাঁদের জানা। নিল বলেন, উহু, বড়জোর এক হাজার টাকা দেওয়া যেতে পারে।

অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে…ছবি: খােলদ সরকার৩ ডিসেম্বর, এই ঘটনা আমরা শুনছিলাম নিল-সম্পা নবদম্পতির ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে বসে। সে কী! শ্যালক-শ্যালিকারা যেখানে ৩০ হাজার চাইছে, আপনি মাত্র এক হাজার বললেন? প্রশ্ন শুনে নিল রাকা হাসেন, আমি নিয়মিত নিউমার্কেটে যাই। দরাদরিটা ভালোই জানি। তা ছাড়া শুরুতে একদম কম বলে একটু মজা করছিলাম আর কি!

সত্যিই খুব মজা হয়েছিল সেদিন। বিয়ের কয়েক দিন আগে থেকেই আমাদের পুরো চারতলা বাড়িটা আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীতে গিজগিজ করছিল। কোথাও গিয়ে একটু একলা বসব, সে উপায় নেই। বলছিলেন সম্পা। সাড়ে চার শ মানুষের আয়োজন, সেখানে সাড়ে সাত শ লোক এসে হাজির! সুরভী-৭ লঞ্চে চেপে ভিনদেশি কুটুম এসেছে, লঞ্চঘাটে ব্যান্ড পার্টি তাঁদের স্বাগত জানিয়েছেগ্রামের লোক তো ভীড় করবেই। তিন দিনব্যাপী হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান।

কুয়াকাটায় মধুচন্দ্রিমা শেষে দুজন ফিরেছেন এই তো সেদিন। নতুন সংসারে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন নবদম্পতি। একজন হল্যান্ডের ওয়াখানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোলজি বিষয়ে পড়েছেন, আরেকজন ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেছেন। কেমন করে এই এক আর এক যোগ হয়ে এক হলো!

 সাদামাটা শুরু
দুজনের প্রথম দেখা দুই বছর আগে। আমি তখন ভিএসওতে (ভলান্টিয়ার সার্ভিস ওভারসিস) চাকরি করতাম। অফিসে বিদেশ থেকে অনেকেই আসত। সেভাবেই একসময় নিল এল। ভালো ছেলে। ভদ্র। খুব সৎ। ওকে পছন্দ করতাম। তবে তখনো ওভাবে আলাদা করে দেখিনি। বলছিলেন সম্পা বালা। আর নিল রাকা? তাঁর দিক থেকে ব্যাপারটা প্রথম দেখায় প্রেম। তারপর? এই তো…ভালো লাগত। নিলের সাদামাটা জবাব। বিস্তারিত শোনার আশায় আমরা একের পর এক প্রশ্ন করি। নাহ্, একটু আড়চোখে চাহনি, কফিশপে আড্ডা, আকারে-ইঙ্গিতে ভালো লাগার কথা বলাতেমন কিছুই পাওয়া গেল না। তখন আমি বাংলাদেশে নতুন এসেছি। এ দেশের নিয়ম-রীতি তেমন কিছুই জানি না। তাই কিছু বলার সাহস পাইনি। নিল বলেন।

 বিয়ে হলো বরিশালে

কদিন বাদে সম্পা অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন। ‘ভাবিনি আর কখনো দেখা হবে।’ বলছিলেন তিনি। কাকতালীয়ভাবেই আবার দেখা হলো দুজনের। সাতক্ষীরায় এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন সম্পা। দাওয়াত করেছিলেন অফিসের পুরোনো সহকর্মী ক্যারোলিন প্রোঙ্ককে।

ওদিকে অফিসের কাজে তখন নিলও ছিলেন সাতক্ষীরায়। ঘটনাক্রমে ক্যারোলিনের সঙ্গে নিলও হাজির হলেন সেই বিয়েতে। তিনি জানতেন না, বিয়েটা সম্পার আত্মীয়ের। ওদিকে সম্পারও জানা ছিল না, নিল আসছেন। এই অনুষ্ঠানেই হলো ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়া। দুজন দুই দিকে চলে গেলেও মুঠোফোনে যোগাযোগ চলল। কী করছ, ভাত খেয়েছ, ঘুমাবে কখন, টুকিটাকি খোঁজখবর রাখা চললো প্রায় ছয় মাস। তত দিনে সম্পা বুঝতে পেরেছেন,

অন্য বিদেশি সহকর্মীদের তুলনায় নিল রাকা তাঁকে একটু অন্য চোখে দেখেন। নিলও কিছুটা সাহস পেয়েছেন। একদিন বলেই ফেললেন ভালো লাগার কথা। কিন্তু ওদিকে সম্পা নিরুপায়, ‘নিলকে পছন্দ করলেও পরিবারের সম্মতি ছাড়া আমি এগোতে চাইনি।’

হল্যান্ডের অধিবাসী নিল রাকাও মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, ‘তবে তা-ই হোক!’

হল্যান্ড থেকে এসে হলুদের আয়োজনেদিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে!

আবারও কাকতালীয় যোগসূত্র! ঘটনাক্রমে সম্পা বালার একজন কাকার সঙ্গে যোগাযোগ হলো নিলের। তিনি এবার পারিবারিকভাবে এগোনোর চেষ্টা করলেন। কাকার মাধ্যমেই প্রস্তাব পাঠালেন সম্পা বালার বাবা স্বপন বালার কাছে। ফলাফলনা সূচক। ভিনদেশি ছেলের কাছে মেয়েকে তুলে দিতে ভরসা পাচ্ছিলেন না স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক স্বপন বালা।

নিল রাকা হাল ছাড়ার পাত্র নন। তিনি বন্ধুত্ব করলেন সম্পার ছোট ভাই দীপ্তর সঙ্গে। দীপ্ত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকায় এসেছে। ফরম কেনা থেকে শুরু করে জমা দেওয়া, খোঁজখবর নেওয়াসব কাজে দীপ্তকে সাহায্য করতে শুরু করলেন নিল। পরের ঘটনা শুনুন সম্পার মুখে। দীপ্তর ভর্তির জন্য বাবা-মা একবার ঢাকায় এসেছিলেন। দুই দিন ছিলেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে টানা দুই দিন নিল আমার মা-বাবার সেবা করেছিল। মা-বাবা ওকে চিনতেন না। দীপ্তর বন্ধু হিসেবেই ও মা-বাবার সঙ্গে ছিল। সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নামার সময় ব্যাগ টানা থেকে শুরু করে হাত ধরে রাস্তা পার করা, বাবা-মাকে মুগ্ধ করার জন্য সব করেছে নিল।

আড্ডার ফাঁকে নিল রাকাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি শাহরুখ খানের বিখ্যাত সিনেমা দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে দেখেছেন?
না তো। হঠাৎ হিন্দি সিনেমার প্রসঙ্গ কেন, নিল ঠিক বুঝতে পারেন না।

এই সিনেমায়ও নায়ক আপনার মতো করে নায়িকার পরিবারের লোকজনের মন জয় করার মিশনে নামে। কারণ শুনে হল্যান্ডবাসী হাসলেন।

সিনেমার মতোই সম্পা আর সম্পার পরিবারের মন জয় করেছেন নিল রাকা। পারিবারিকভাবেই হয়েছে দুজনের বিয়ে। ছবি তোলার জন্য তখন আমরা ধানমন্ডি লেকে গেছি। দুজন পাশাপাশি দাঁড়ালেন, দৃশ্যটা রূপকথার গল্পের শেষ দৃশ্যের মতোই লাগছিল। অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল…!’




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025