সামিউল্লাহ সমরাট: পর্যটন নগরী সিলেটের প্রবেশ পথেই রয়েছে একটি প্রাচীন লোহার ব্রিজ এবং একটি ঘড়িঘর । সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এই দুটি স্থাপনা নিয়ে আজকের পর্ব ।
সিলেট শহরকে দুভাগে বিভক্ত করেছে সুরমা নদী । এই নদীর উত্তর পারে মূল শহরটি অবস্থিত আর দক্ষিণ পাড়ে রেলষ্টেশন ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল । স্টেশন রোড থেকে শহরে ঢুকতে হলে লোহার ব্রিজটির উপর দিয়ে যেতে হয়। লাল রঙের এই ব্রিজের নাম কীন ব্রিজ । ক্বীন ব্রিজ সিলেটের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ ।
একসময় সিলেটের সাথে ভারতের আসামের ভাল রেল যোগাযোগ ছিল । সঙ্গত কারনেই সুরমা নদীর উপরে ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । ১৮৮৫ সালে সিলেট মিউনিসিপ্যালটি কমিটি গঠিত হয় । এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৩৩ সালে ব্রিজটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় আসাম রেল বিভাগ । ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি উদ্বোধন করা হয় । আসামের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কিনের নামে ব্রিজের নামকরণ করা হয় ক্বীন ব্রিজ । ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ১১৫০ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট ।
জানা যায়, এটি নির্মাণে তৎসময়েই ৫৬ লাখ টাকা ব্যায় হয় । ব্রিজটির আকৃতি ধনুকের ছিলার মুত বাঁকানো । মূলত ব্রিজের নিচ দিয়ে জাহাজ ও বড় নৌকা নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্যই এই আকৃতি । ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে বীজটির উত্তর পাশের কিছু অংশ ধ্বংস করে দেয় । স্বাধীনতার পরে সেটুকু সাময়িক মেরামত করা হয় । ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহায়তায় বিধস্ত অংশটুকু কংক্রিট দিয়ে পুনরায় নির্মাণ করা হয় । এখন সুরমা নদীর উপরে আরও দুটি নতুন ব্রিজ নির্মাণ হওয়ায় কীন ব্রিজের উপর দিয়ে ভারি যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।
এই প্রাচীন স্থাপনাটি দেখতে প্রতিদিন অনেকেই ছুটে আসেন । সন্ধ্যার সময় থকে শুরু করে অনেক রাত পর্যন্ত এই ব্রিজের নিচে নদীর পাড়ে মানুষ জনের ভিড় থাকে।
ক্বীন ব্রীজের পাশেই চাঁদনীঘাটে রয়েছে সিলেটের আরেক ঐতিহ্য আলী আমজাদের ঘড়ি। কীন ব্রিজ থেকে নীচের দিকে তাকালে, চাঁদনী ঘাটের কাছেই চোখে পড়ে আলী আমজাদের ঘড়ি। উনবিংশ শতকের একটি স্থাপনা, যা মূলত একটি বিরাটাকায় ঘড়ি, একটি ঘরের চূড়ায় স্থাপিত।
কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালীপনা আর অবহেলায় সিলেটের এ প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘড়িঘরটি এখন অচল অবস্থায় পড়ে আছে। ঘড়িটি নির্মিত হয় ১৮৭৪ সালে। সে সময় তৎকালীন বড়লাট লর্ড নর্থ ব্রুক সিলেট সফরে এলে তার সম্মানে এ ঘড়ি নির্মাণ করা হয় আলী আমজাদের জমিদারীর তহবিলের অর্থ থেকে। তাই এ ঘড়িটি আলী আমজাদের ঘড়ি হিসেবেই পরিচিত।
ঘড়ির ডায়ামিটার আড়াই ফুট এবং ঘড়ির কাঁটা দুই ফুট লম্বা। এ অঞ্চলে যখন ঘড়ির অবাধ প্রচলন ছিল না, মানুষ সূর্যের দিকে তাকিয়ে সময় আন্দাজ করতো, ঠিক সে সময় এ ঐতিহাসিক ঘড়িঘরটি নির্মিত হয়। সে আমলে মানুষজন শহরের প্রবেশপথে স্থাপিত ঘড়িঘরের সময় দেখে শহরে আসা-যাওয়া ও কাজকর্ম সম্পাদন করতেন।
লোহার খুঁটির ওপর ঢেউটিন দিয়ে সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির এ মনোরম স্থাপত্যশৈলীর পরিচায়ক ঘড়িঘরটি তখন থেকেই আলী আমজাদের ঘড়িঘর নামে পরিচিতি লাভ করে। বিরাট আকারের ডায়াল ও কাঁটা সংযুক্ত সুবিশাল ঘড়িটির ঘণ্টাধ্বনি শহরের বাইরে অনেকদূর থেকেও শোনা যেত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে এই প্রাচীন ঘড়িঘর বিধ্বস্ত হয়।
স্বাধীনতার পর সিলেট পৌরসভা ঘড়িটি মেরামতের মাধ্যমে সচল করলেও কিছুদিনের মধ্যেই ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে আলী আমজদের ঘড়ি মেরামত করে পুনরায় চালু করা হয়।
এসময় ঘড়িটি চালু করার পর ঢাকার একটি কোম্পানীর কারিগররা ঘড়িটি চালু রাখার জন্য রিমোট কন্ট্রোলের ব্যবস্থা করে দেয়। পৌর চেয়ারম্যানের অফিসকক্ষ থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতো। কিন্তু দুই-চার বছর যেতে না যেতেই ঘড়ির কাঁটা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর সিজান কোম্পানীর দ্বারা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে ঘড়িটি পূনরায় চালু করা হয়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ঘড়িটির কাঁটা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এই ঘড়িটিকে পূণরায় মেরামত করলে তা আবার দৈনিক ২৪ ঘন্টাব্যাপী সচল রয়েছে।