জোসেফ এস নাইঅনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, ২০১৪ সালে শীতল যুদ্ধের ঢঙের ভূরাজনীতি শুরু হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসন ও ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের কারণে পশ্চিম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর বড়সড় অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে।
এর ফলে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে চিড় ধরেছে। আর ক্রেমলিনও চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া কি এই জনগণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই কোনো জোট গঠন করতে পারবে।
প্রাথমিকভাবে মনে হয়, এটা সম্ভব। হ্যাঁ, প্রথাগত ক্ষমতার ভারসাম্যের খেলায় ক্ষমতার সম্পদের ক্ষেত্রে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে এই রুশ-চীন অংশীদারত্ব দাঁড়াবে। আরও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, এরূপ অংশীদারত্বের ঐতিহাসিক নজিরও রয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২ সালে চীনের ব্যাপারে মুক্ত অবস্থান নিলে পাশা ঘুরে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল, সেটা মোকাবিলায় তারা একত্র হয়।
পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন-চীন কার্যত (বিধিগতভাবে না হলেও) জোট শেষ হয়ে যায়, আর চীন-রাশিয়ার মধ্যে গালাগাল শুরু হয়। ১৯৯২ সালে দেশ দুটি ঘোষণা করে, তারা একটি ‘গঠনমূলক অংশীদারত্ব’ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এরপর ১৯৯৬ সালে তারা একটি ‘কৌশলগত অংশীদারত্বের’ দিকে অগ্রসর হয়। আর ২০০১ সালে তারা ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার’ চুক্তি স্বাক্ষর করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একে অন্যকে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছে। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তারা একই অবস্থান নিয়েছে। তারা নিজেদের নীতিগত অবস্থান সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক কাঠামো ব্যবহার করেছে। যেমন, প্রধান প্রধান উদীয়মান দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস (ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে) ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে) গঠনের মাধ্যমে তারা এটা করেছে। আর ভ্লাদিমির পুতিন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একটি ভালো কাজের সম্পর্ক গঠন করতে পেরেছেন। তাঁদের ভিত্তি দুটি: মার্কিন আদর্শ ও আধিপত্য মোকাবিলা ও অভিন্ন অভ্যন্তরীণ অনুদারতা।
অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত বছর ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পরপরই রাশিয়া চীনের সঙ্গে ৩০ বছরের জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলারের একটি গ্যাস চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে ২০১৯ সাল থেকে রাশিয়া ৩০ বছর বার্ষিক ৩৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করবে। রাশিয়ার মহিরুহ রাষ্ট্রীয় জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের সঙ্গে চীনের ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের এই চুক্তির আওতায় চীনের হেইলঙগিজাঙ প্রদেশ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ মাইল লম্বা পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে (যেখানে কয়েক বছর আগে দেশ দুটি প্রায় যুদ্ধে লিপ্ত হতে বসেছিল)। প্রকৃত মূল্য গোপন রাখা হলেও ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া এই চুক্তিটি করার জন্য অনেক ছাড় দিয়েছে। এর আগে দশকব্যাপী দামাদামিও হয়েছে।
তাছাড়া, এই নভেম্বরে গাজপ্রম পশ্চিম সাইবেরিয়া থেকে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নতুন আরেকটি পাইপলাইনের মাধ্যমে ৩০ বছরের জন্য আরও ৩০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত ঐকমত্যের ঘোষণা দিয়েছে। এই পরিকল্পিত ‘পূর্ব’ ও ‘পশ্চিম’ পাইপলাইন নির্মাণ শেষ হলে রাশিয়া চীনে বার্ষিক ৬৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করবে। ফলে সে যে বর্তমানে জার্মানিকে বছরে ৪০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে, তা এর কাছে হার মানবে।
মনে হতে পারে, এটা এক গভীরতর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু এখানে একটি বাধা আছে: এই গ্যাস চুক্তি দেশ দুটির মধ্যকার উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়াবে। রাশিয়া চীনকে কাঁচামাল সরবরাহ করছে আর চীনা উৎপাদিত পণ্য কিনছে। রাশিয়া যে পশ্চিমের প্রযুক্তি লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এই গ্যাস চুক্তি সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। রাশিয়া সুমেরুর সীমান্তে যে ক্ষেত্র বানাতে চায় ও নিজে জ্বালানি পরাশক্তি হতে চায়, সে জন্য তার এই পশ্চিমা প্রযুক্তি দরকার। সে নিশ্চয়ই শুধু চীনের গ্যাসক্ষেত্র হতে চায় না।
বস্তুত, চীন-রাশিয়ার এই জোটের সমস্যার সীমা আরও ব্যাপ্ত। চীনের অর্থনীতি, সামরিক শক্তি ও জনসংখ্যা রাশিয়ার জন্য প্রভূত অস্বস্তির কারণ। সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যাগত অবস্থানের কথাই ভাবুন না কেন, সেখানে মাত্র ৬০ লাখ রুশির বসবাস, আর সীমান্তের ওপারেই ১২ কোটি চীনার বসবাস।
আর রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এখন ক্ষয়িষ্ণু, আর চীন সবদিক থেকেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে। চীনের এই ঐতিহ্যবাহী সামরিক উৎকর্ষের কারণেই সম্ভবত, অংশত, রাশিয়া ২০০৯ সালে নতুন সামরিক মতবাদ ঘোষণা করে, এতে পরিষ্কারভাবে প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার উল্টে দেওয়া হয়। এটা শীতল যুদ্ধের সময়ের মার্কিন বল প্রয়োগ নীতির সমতুল্য। যার লক্ষ্য ছিল ইউরোপের উৎকৃষ্ট সোভিয়েত বাহিনীকে থামিয়ে দেওয়া। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে মনে হয়, রাশিয়া চীনের সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কে জড়াবে না। যদিও দেশ দুটি পারস্পরিক লাভজনক কূটনৈতিক সহযোগিতার নীতিতে আবদ্ধ।
রাশিয়াকে চীনের সহযোগিতা করার ইচ্ছারও একটি সীমা রয়েছে। যাহোক, চীনের উন্নয়ন কৌশলের একটি দিক হচ্ছে, তারা অব্যাহতভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির মধ্যে ঢুকতে চায়। বিশেষ করে, তারা বিশ্বাসযোগ্যভাবে মার্কিন বাজারে ঢুকতে চায়, তাদের প্রযুক্তির নাগাল পেতে চায়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকার হচ্ছে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। রাশিয়ার সঙ্গে ‘কর্তৃত্বপরায়ণ জোট’ গঠনের জন্য তারা কোনো রকম ঝুঁকি নেবে না।
এমনকি বহুপক্ষীয় ফোরামেও চীন-রাশিয়া সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ নয়। ব্যাপার হচ্ছে, চীনের অর্থনীতি ব্রিকসের অন্য চার সদস্যের অর্থনীতির সম্মিলিত আকারের চেয়েও বড়। তাদের উন্নয়ন ব্যাংকেও চীনের অংশীদারি এদের সবার মিলিত অংশীদারির চেয়ে বড়। ফলে এই গ্রুপটির উদ্যোগে চীনের অসম প্রভাব বিস্তারের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন কিছু কূটনৈতিক সমন্বয়ের প্রক্রিয়া সহজতর করেছে, চীন ও রাশিয়া কেন্দ্রীয় এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় দ্বৈরথে অবতীর্ণ হয়েছে।
বিংশ শতকের চীন-রাশিয়া জোট আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ও শীতল যুদ্ধ শুরুর সময় চীনা দুর্বলতার ফসল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আর তখনো সেটা এক দশকের বেশি কিছু সময় টিকে ছিল। আজকের চীন অনেক শক্তিশালী। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে সে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়াবে না। কারণ, রাশিয়ার নেতার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তার পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে।
সংক্ষেপে বললে, চীন-রাশিয়া জোটের পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না সম্ভবত। তা পুতিন যত আশা–ই করুন না কেন, ২০১৪ সালটি রাশিয়ার সফল পররাষ্ট্রনীতির বছর হিসেবে পরিগণিত হবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ এস নাই: সাবেক মার্কিন সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী।