শাহ্ মোস্তফা কামাল: আধুনিক প্রযুক্তিতে সবজি চাষ করে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এলাকায় সবজি বিপ্লব ঘটিয়ে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শায়েস্তাগঞ্জের আবদুল কাইয়ুম। কৃষক কাইয়ুম বলেন, রোদ-বৃষ্টির সঙ্গে মিতালি আর কঠোর পরিশ্রমের কাজ কৃষি। যারা আরামপ্রিয় তারা কৃষিকে এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু এই কষ্টের ভেতরেও যে আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে তা অনেকেই জানেন না।
যারা এই কষ্টকে ধারণ করতে পারেন তারা কোন সময়ই ব্যর্থ হন না। বিষমুক্ত বিভিন্ন ধরনের টমেটো, লাউ, বরবটি, শসা, শিম চাষ করে অল্প সময়েই নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছেন আবদুল কাইয়ুম। তার খামারে উৎপাদিত টমেটো, লাউ, শসা, বরবটি এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। উৎপাদিত বিভিন্ন শাকসবজি গুণগত মান ও বিষমুক্ত হওয়ায় খামার থেকেই রপ্তানিকারকরা টমেটো, লাউ, বরবটি, লাল শাক, শসা, করল্লা, বেগুন সংগ্রহ করে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছেন। শায়েস্তাগঞ্জ থানার পৌর শহরের ৯নং নিজামপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বাগুনিপাড়া গ্রামের স্বনামধন্য ব্যক্তি কৃষক আবদুল কাইয়ুম কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার বিনিময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন কৃষি খামার। সেখানে সাথী ফসলের আবাদ করে পেয়েছেন আশাতীত সাফল্য।
প্রায় শূন্য থেকে তিন কোটি টাকার অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছেন এই উদ্যমী কৃষক। তার এই সফলতায় কৃষি বিপ্লব ঘটেছে বাগুনীপাড়ার অজপাড়া গ্রামে। শায়েস্তাগঞ্জ থানার পৌর শহর এলাকার অজপাড়া বাগুনীপাড়া গ্রামের মো. আবদুল কাইয়ুম একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। পৈতৃক জমিজমা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ২ বিঘা জমিই ছিল তার সম্বল। জীবনের প্রথমদিকে সনাতন আবাদে এই জমিগুলো থেকে তেমন একটা লাভবান হতেন না তিনি।
এক সময় জমিগুলোতে লাভের জন্য আখচাষও করেছেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ১৯৯০ সালে তার ৫ শতক জমিতে বারীর রুমা প্রজাতির টমেটো, শসা, লাউ, বরবটি আবাদ করে আশাতীত সাফল্য পান। পেয়ে যান নতুন পথের সন্ধান। সেই সময়ে তার ৫ শতক জমির এই টমেটো বিক্রি থেকে তার প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। এই মুনাফা দেখে কৃষক আবদুল কাইয়ুম কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় ও পরামর্শ নিয়ে শুরু করেন সবজি আবাদ। তবে সনাতন পদ্ধতিতে নয়। উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগাম সবজি আবাদে মনোযোগ দেন তিনি।
একই জমিতে অধিক ফলন ও সারা বছর ফসল পেতে শুরু করেন সাথী ফসলের আবাদ। জমিতে টেংরা বাঁশ ও সুতা দিয়ে মাচা তৈরি করা হয়। পৌষ ও মাঘ মাসে আবাদ করা হয় টমেটো। ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত ফসল পাওয়া যায়। টমেটো, লাউ, শসা, বেগুন, করল্লা, বরবটি সহ নানা জাতের সবজি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে নেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। পাইকাররা ক্ষেত থেকেই ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে এসব সবজি। চৈত্র মাসে লাগানো হয় বরবটি। এই ফসল পাওয়া যায় বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত।
আর আষাঢ় মাসে লাগানো হয় করল্লা। পাশাপাশি একই সময়ে মাচায় অন্যান্য সবজিও আবাদ করা হয়। কৃষক মো. আবদুল কাইয়ুম এ বছর টমেটো বিক্রি করে আয় করেছেন ১০ লাখ টাকা। করল্লা থেকে আয় করেছেন ১ লাখ টাকা। বরবটি থেকে আয় তার ১ লাখ টাকা। বেগুন, লাউ, সিম ও চাল কুমড়া সহ অন্যান্য ফসল থেকে আয় করেছেন ২ লাখ টাকা। তার খামারে প্রতিদিন কাজ করে ১০ জন শ্রমিক। তাদেরকে দেয়া হয় দৈনিক ৩শ’ টাকা করে। যা অন্যান্য স্থানের তুলনায় একটু বেশি মজুরি। খামারে তিনি জৈবিক সার বেশি ব্যবহার করেন। মধ্য বয়সী এই কৃষক হরেক রকমের সবজি ও চাষাবাদ করেছেন।
কৃষক আবদুল কাইয়ুম এ প্রতিবেদককে জানান, এক সময় কৃষি কাজ করতে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন আর ঋণের প্রয়োজন নেই, কষ্ট করলে যে সফলতা আসবে সে বিশ্বাস আমার ছিল। এখন অনেক লোক আমার নিকট আসে পরামর্শের জন্য। আমি সবাইকে পরামর্শ দেই। তবে আমার এখানে যারা কাজ করে তারাও নিজেদের জমিতে ভাল সবজি আবাদ করছেন। কৃষির আয় থেকে কাইয়ুম তার সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। তার ৪ সন্তানের সবাই এসএসসি পাস করেছেন। একজন পড়ছেন কলেজে। এই আয়ে তার বাড়িতে দালান ঘর তৈরি করেছেন।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২ বিঘা জমি বেড়ে হয়েছে ১২ বিঘা। এর ৮ বিঘাতে আবাদ হয় সবজি এবং ৪ বিঘাতে আবাদ করা হয় ধান। ক্রয় করেছেন ১টা ট্রাক্টর, ১টা পাওয়ার ট্রিলার, ১টা ধান মাড়াই মেশিন, ২টা অগভীর নলকূপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। তার এই সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের প্রায় ৪ শ’ কৃষক সবজির খামার গড়তে উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি নিয়মিত কৃষি বিভাগের পরামর্শ নেন এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেন। কৃষি খামার থেকে উৎপাদিত ফসল কিনতে অনেক সময় পাইকাররা ট্রাক নিয়ে আসেন আবদুল কাইয়ুমের কাছে।
জেলা ও থানার বিভিন্ন এলাকায় সরজমিন দেখা যায় খামারের বিভিন্ন এলাকা জুড়ে এখন বিভিন্ন জাতের টমেটো, বেগুন, শসা, বরবটি, লাউ, কুমড়ার সবুজের সমাহার। ১২ জন শ্রমিক জমি থেকে টমেটো সহ বিভিন্ন ধরনের সবজি সংগ্রহ করে আর ৫ জন ৬/৭ কেজি করে সবজি কার্টনে সুন্দর করে প্যাকেট করছে। কথা হয় আবদুল কাইয়ুমের জমিতে শ্রমিকের কাজ করা বাবুল, মুরাদ ও ময়না মিয়ার সঙ্গে। তারা জানায়, এখানে যারা কাজ করে তারা পারিশ্রমিক পায়। কাজ করার পাশাপাশি নিজেদের জমিতেও বিভিন্ন প্রকার সবজি আবাদ করেন তারা।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ ও নিউটন অধিকারী জানান- কৃষক কাইয়ূম কোন সমস্যা হলে অথবা পরামর্শের জন্য তাদের কাছে আসেন। এব্যাপারে তাকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হয়। কাইয়ুম প্রমাণ করেছেন পরিশ্রম আর বুদ্ধি থাকলে দেশেই ভাল কিছু করা সম্ভব। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র সোম জানান, একজন কৃষক যদি বাড়িতে থেকেই বছরে ২০ লাখ টাকা আয় করতে পারে তা অনেক বড় সফলতা। কাইয়ুম পরিশ্রম আর সাধনা করে এই পর্যায়ে এসেছেন। তাকে যদি সবাই অনুসরণ-অনুকরণ করে তাহলে এ দেশের বেকার যুবসমাজ উপকৃত হবে এবং পাশাপাশি দেশের কৃষি উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।