শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪১

মার্কিন-চীন সম্পর্কের নতুন ব্লুপ্রিন্ট

মার্কিন-চীন সম্পর্কের নতুন ব্লুপ্রিন্ট

আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: চীন ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কের চলমান পালাবদল যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, তার ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের বৈশ্বিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও সুশাসন। এই সম্পর্কের চেয়ে অন্য কোনো বিষয় এসব নির্ধারণে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না।

দীর্ঘ মেয়াদে দেখা যাবে, আজকের যে অন্যান্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি—এসব সমস্যা উপন্যাসের পার্শ্বচরিত্রের রূপ নিয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক হবে প্রধান চরিত্র।

চীন-মার্কিন সম্পর্ক আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, দুই দেশেরই শক্তিশালী বিভিন্ন গোষ্ঠীও সংঘাতের পথে হাঁটতে চাইছে। চীন শি জিনপিংয়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। তারা আর দেং জিয়াওপিংয়ের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলছে না।

দেংয়ের নীতি ছিল এ রকম: নিজের শক্তি গোপন রাখো, অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করো আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কখনো নেতৃস্থানীয় অবস্থান নিয়ো না। তারা খোলামেলাভাবেই সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা দেখিয়ে আসছে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের এই আগ্রাসী মনোভাব পরিষ্কার দেখা গেছে। এমনকি তারা সে অঞ্চলে অন্তহীন মার্কিন আধিপত্য প্রতিরোধের ইচ্ছাও খোলামেলাভাবে দেখিয়েছে। তাদের এখন ভাবছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে একঘরে করতে চায়, বশে এনে খাটো করতে চায়।

দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাজের দৃষ্টান্ত দেখে চীনের এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। মার্কিন নীতি প্রণেতারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত যা-ই বলুন না কেন, তাঁরা জনসমক্ষে যা বলছেন ও করছেন, তাতে বোঝা যায় যে তাঁরা বিশ্বের আধিপত্যকামী শক্তি হিসেবেই থাকতে চান। বিশেষ করে এশিয়ায় তাঁরা যেন অনন্তকাল ধরে বিরাজমান আধিপত্য বজায় রাখতে চান।

সম্প্রতি রবার্ট ব্ল্যাকঅয়েল ও আশলে টাইলস প্রণীত রিপোর্ট ফর দ্য কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সে যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান বজায় রাখার সবচেয়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মার্কিন গ্যান্ড স্ট্র্যাটেজির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বৈশ্বিক ব্যবস্থায় মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখা। সেখানে তাঁরা চীনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একাধিক আগ্রাসী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। তাঁরা বলছেন, এটা কাউকে ‘সংবরণ’ করার নীতি নয়, কিন্তু আদতে এটা তার চেয়ে কম কিছু নয়।

এই সম্পর্ককে চালিয়ে নেওয়ার আর কোনো উপায় আছে কি, যেখানে এই শক্তিসমূহের বাস্তবতা ও মনোভাব প্রতিফলিত হবে, কিন্তু এই বৈধ প্রতিযোগিতা বিপজ্জনকভাবে যুদ্ধংদেহী অবস্থায় পর্যবসিত হবে না? অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের জন্য প্রণীত প্রতিবেদনে তেমনই এক কৌশল বাতলে দিয়েছেন। তিনি এর নামকরণ করেছেন ‘গঠনমূলক বাস্তবতা’। মোড়ক হিসেবে এটা খুবই নিস্তেজ, কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণ ও নীতিগত পরামর্শ সত্যিই আগ্রহোদ্দীপক।

রাডের যুক্তির ‘বাস্তব’ মাত্রায় এটা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে মতানৈক্যের কয়েকটি ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতেও লাগাম দেওয়া যাবে না: তাইওয়ানসহ দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে ভূমিবিরোধ, এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী ও চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আইনি ভিত্তি। তারা সহজ সমাধানকে অগ্রাহ্য করে যাবে, ফলে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগুলোর ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

রাডের অভিসন্দর্ভের ‘গঠনমূলক’ অংশে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিজের সমকক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করবে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিসরের কঠিন সমস্যাগুলো যাতে সামলানো যায়। দ্বিপক্ষীয়ভাবে, এমন সহযোগিতার মধ্যে হয়তো বিনিয়োগ নীতি, সন্ত্রাসবাদবিষয়ক যৌথ টাস্কফোর্স গঠন, সাইবার-নিরাপত্তা প্রটোকল, অপরিকল্পিত সামরিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণে মতৈক্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ ও কম্প্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটিতে দুই পক্ষের অনুসমর্থন প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে।

আঞ্চলিক ক্ষেত্রে রাডের কথা হচ্ছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র রোধে একত্রে কাজ করতে পারে, কোরিয়া উপদ্বীপের একত্রীকরণে সহায়তা করতে পারে, জাপানের ক্রমেই গভীর হতে থাকা যুদ্ধ ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারে, আঞ্চলিক বাণিজ্য মতৈক্য সমন্বয় করতে পারে; আর পূর্ব এশিয়া সামিটকে আরও পূর্ণাঙ্গ এশিয়া-প্যাসিফিক সম্প্রদায়ে রূপ দিতে পারে।

ওদিকে রাড মনে করেন, বৈশ্বিক পরিসরে দেশ দুটি যৌথ কর্মসূচি নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, জি-২০-কে পুনর্জীবিত করা, চীনের মুদ্রাব্যবস্থা রেনমিনবিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়া; বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে চীনকে আরও গুরুত্ব দেওয়া আর জাতিসংঘের পরিচালনাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংস্কার প্রভৃতি করতে পারে।

প্রবীণ চীন বিশেষজ্ঞ ডেভিড শ্যামবাঘসহ পশ্চিমের অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের সহযোগিতামূলক ছাড় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা হবে না। এ ব্যাপারে তারা মোটামুটি নিঃসন্দেহ। তার কারণ হিসেবে তাঁরা মনে করেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে চীন নিজে থেকে ধসে যাবে। রাডের যুক্তি হচ্ছে, এঁরা ভুল করছেন। শি কখনোই নিজের কর্তৃত্বপরায়ণতায় বেশি জোর দেবেন না, আবার প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে এমন কিছুও করবেন না। চীনের উত্থান চলতেই থাকবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সবাইকে নীতিভিত্তিক পথ খুঁজে বের করতে হবে, যাতে তাকে এই ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে স্থান দেওয়া যায়।

রাডের সুপারিশে উচ্চাভিলাষ আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর পরিচিতির কথা বিবেচনা করে রাডের কথায় গুরুত্ব দিতে হবে। রাড একজন বিশিষ্ট চীনা ভাষাতাত্ত্বিক, সৃজনশীল নীতি চিন্তক; চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাডের জামানা খুব একটা সুখকর ছিল না, কিন্তু তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার তুলনা হয় না। সমকালে বা গত ৩০ বছরে যত নেতাকে দেখেছি, তাঁদের মধ্যে তিনিই এ ক্ষেত্রে সেরা

(তিনি জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব হতে চান, সে কারণে এসব বলছি না। এই পদে প্রধান শক্তিগুলো চোখ-কানহীন মানুষকেই পছন্দ করে, সৃজনশীল মানুষদের নয়)। সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই দেশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলতেই স্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু আমাদের এটা আশা করা উচিত যে আগামী দিনগুলোতে আমরা ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ ‘আধিপত্য’ প্রভৃতি শুনব না, আমরা শুনব সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা। যুক্তরাষ্ট্র চীনবিষয়ক এমন নীতি নিলেই কেবল একুশ শতক আশাবাদী হতে পারে, দুনিয়াটা আগের শতকের মতো আর কান্নার উপত্যকা হবে না।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

গ্যারেথ ইভান্স: অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024