আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: কক্সবাজারের টেকনাফের কাছাকাছি নাফ নদীতে মালয়েশিয়াগামী ৩০০ অভিবাসী নিয়ে ভাসছে একটি ট্রলার। দুইমাস আগে টেকনাফ থেকে মালেয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে ট্রলারটি।
পরে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে সেনা ও পুলিশের অভিযানের খবর পেয়ে সেটি ফেরত এসেছে। কিন্তু তীরে ভিড়ছে না আটক হওয়ার ভয়ে। এদিকে, ভাসমান মানুষদের কাছে খাবার নেই। নেই এক ফোঁটা পানিও। তারপরও তীরে ফিরতে পারছেন না আতঙ্কে। সেখানে আটকা ৩০০ জনের মধ্যে দেড়শজন রয়েছেন বাংলাদেশি।
এর মধ্যে সাতজনের জন্য ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ছয়জনকে ফেরত দিয়েছে বাংলাদেশি দালাল। কিন্তু একজনের পরিবার মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা ৩০ হাজার টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকা দিতে না পারায় আটকে রাখা হয়েছে। আটক তরুণের নাম কাজী মহিউদ্দিন। তাকে শিপে (মূলত ট্রলার) দড়ির চাবুক দিয়ে পেটানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার বাবা কাজী তৌহিদ।
কাজী তৌহিদ পেশায় একজন গৃহস্থ। কৃষিকাজ করেই তার সংসার চলে। তার বাড়ি টেকনাফের শিবপুর গ্রামে। তার ছেলে কাজী মহিউদ্দিন বর্তমানে জাহাজে আটকা রয়েছে। জাহাজটি টেকনাফের কাছে ভাসছে বলে দালাল মারফত জেনেছেন তিনি। মঙ্গলবার ফোন করে নির্মম ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।
তিনি জানান, ওই শিপে (মূলত ট্রলারে) আটকা রয়েছেন মোট ৩০০ অভিবাসী। এর মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছেন দেড়শ জন। বাকিরা কোন দেশের তা তিনি জানেন না। কাজী তৌহিদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মহিউদ্দিনই বড়। লেখাপড়া জানে না। অভাব-অনটনের কারণে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল সে। দুইমাস আগে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ট্রলারে চড়ে। পরে বাড়িতে জানায়, সে মালয়েশিয়া যাচ্ছে। এ সময় দোয়া করতে বলে সে।
কিন্তু দুই মাস ধরে মহিউদ্দিনের খোঁজ না পেয়ে সপ্তাহখানেক আগে থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া যাওয়া তাদের গ্রামের এক ছেলে বশরের কাছে ফোন দেন। তাকেও থাইল্যান্ডের এক জঙ্গলে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে ফোনে বাড়িতে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ হিসেবে আড়াই লাখ টাকা দেওয়া হয় দালাল চক্রকে। এরপর তাকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেয় দালালরা। কাজী তৌহিদ জানান, বশরকে ফোন দিলে থাইল্যান্ডে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় এক বাঙালি দালাল (ফোন- +৬০১৩৪৫২০০৯৭) ফোনকল রিসিভ করে। কিন্তু সে তার পরিচয় না দিয়ে টাকা চায়।
এদিকে, দুইমাস পর জাহাজ (ট্রলার) টেকনাফের কাছে এসে পৌঁছালে দালাল জসিম কাজী তৌহিদকে ফোনে জানান, তার ছেলে জাহাজে আছে। তাকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া একই গ্রামের আরো ছয়জনকে একই খবর দেয় দালাল জসিম।
এরপর তিনি সাতজনকে ছাড়িয়ে নিতে ৭০ হাজার টাকা দুটি ফোন নম্বরে বিকাশ করেন (বিকাশ নম্বর- ০১৮৫০-৭৯৭ ৯৬৬, ০১৮৫০-৭৯৭ ৮২০। এ নম্বর দুটি ব্যবসায়িক নম্বর বলে জানান তিনি। তার ছেলের জন্য তিনি ১০ হাজার টাকা বিকাশ করেন। কিন্তু দালালরা তার ছেলে কাজী মহিউদ্দিনকে ফেরত না দিয়ে আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
কাজী তৌহিদ জানান, তার ছেলে মহিউদ্দিনকে দড়ির চাবুক দিয়ে পেটানো হয়েছে। এতে করে সে জাহাজের ভেতরে পড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, দালাল জসিম (ছোট ডিঙি নৌকার মাঝি) (ফোন নম্বর- ০১৮৫৯২২৬৮০৯) বাকি ছয়জনকে টেকনাফে নামিয়ে দিয়ে গেছে ৪/৫ দিন আগে।
কাজী তৌহিদ আরো কয়েকজন দালালের নাম জানিয়েছেন। তারা হলেন- টেকনাফের শিবপুর গ্রামের মাসুম মিয়া (৩৫)। আরেক দালালের নাম জাকির মিয়া। নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানায় তার বাড়ি। থাকেন চিটাগাং রোড। পরে ধরপাকড় শুরু হলে তিনি তার ফোনটি বন্ধ করে দেন। তার ফোন নম্বর- ০১৭১৫ ৯০৯ ১৩৫। অন্য দালালের নাম নায়েব আলী। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার গয়াশপুর গ্রামে। তার ফোন নম্বর ০১৭১৯ ৫৯১০৩৩।
এখনো নিখোঁজ উল্লাহপাড়ার আশরাফুল। সিরাজগঞ্জের উল্লাহপাড়ার চারতারাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আ. রশিদ (বাঘা) জানান, তার বড় ছেলে আশরাফুল (২৮) স্থানীয় দালালের খপ্পরে পড়ে ৯ মার্চ সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জামায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি।
তিনি জানান, তার ছেলে আশরাফুলের উল্লাহপাড়ার কাছে বাউশাবাজারে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান ছিল। সেখানে আসা-যাওয়া ছিল দুই দালালের। তারা হলেন- হেলাল (২৮) ও চান মিয়া। চান মিয়া ওই বাজারে চালের ব্যবসা করেন। তার ছেলে আল-আমিন ১০/১২ বছর ধরে মালয়েশিয়া বসবাস করছে।
চান মিয়া ছেলের প্রস্তাব মতো গ্রামের তরুণদের কম টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়া এবং সেখানে ভালো আয়ের উপায় আছে বলে প্রলোভন দেখায়। এ প্রলোভনে পড়ে আশরাফুল তার দোকান ছেড়ে সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য আনতে মালয়েশিয়া যাত্রা করে। কিন্তু সংসারে সুখ আনা তো দূরের কথা, তার কোনো সন্ধানই করতে পারছেন না বাবা আ. রশিদ। এখন কী করবেন, কোথায় যাবেন তা জানেন না তিনি। যখন তাকে মঙ্গলবার দুপুরে ফোন দেওয়া হয়, তখন তিনি ধানক্ষেতে কাজ করছিলেন। অসহায়ভাবে তিনি তার কষ্টের কথা বর্ণনা করেন তিনি।