সিয়াম সাধনার প্রক্রিয়া, প্রবৃত্তির চাহিদা ও রিপু দমনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে আত্ম সংশোধনের সৃষ্টি হয় তা একজন মু’মিনকে মুত্তাক্কী পর্যায়ে উন্নত করে।
আর এই তাক্কাওয়া অর্জন সিয়াম সাধনার প্রকৃত উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা সূরা আল বাক্কারার ১৮৩ নং আয়াতে রোযার নির্দেশ করে বলেছেন, ‘আশা করা যায় এর মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে তাক্কওয়া সৃষ্টি হবে’। বছরের পর বছর যদি আমার রোযা রাখতেই থাকি কিন্তু আমাদের মধ্যে তাক্কওয়া অর্জন হয় না তাহলে রোজার মূল উদ্দেম্য থেকে আমরা বঞ্চিতই থেকে যাব।
আংশিক ছওয়াব পেলেও আমরা পুরো ছওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবো। শুধু পানাহার আর সহবাস থেকে বিরত থাকলেই প্রকৃত রোযা হয় না। প্রকৃত রোজা হচ্ছে নিজের নফস্ ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় পরিচালিত করা। যাবতীয় গুনাহ বা অন্যায়ের কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যে মিথ্যা করা, অন্যায় কাজ ও জাহেলী তৎপরতা থেকে নিজেকে বিরত রাখে না, আল্লাহর কোন দরকারই নেই সে শুধু খানাপিনা থেকে বিরত থাকবে।-(বুখারী) রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, কিছু রোযাদার এমন রয়েছে যে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া তাদের রোযার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে।
তিনি এরশাদ করেছেন আরেকটি হাদীসে, তোমাদের কেউ যেদিন রোযা রাখে সেদিন যে কোন মন্দ কথা উচ্চারন না করে, গালমন্দ না করে, আর কেউ যদি তাকে অন্যায় কথা বলে বা গালমন্দ করে সে যেন বলে দেয় আমি রোযাদার-(বুখারী)।
এ আত্মসংযমই হচ্ছে রোযার মূল শিা। সাহাবায়ে কেরাম এভাবেই রোযার মর্ম উপলবদ্ধি করেছিলেন। হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘তুমি যখন রেযা রাখবে, তখন যে কর্ণ ও চু রোযা রাখে, তোমার কণ্ঠও যেন রোযা রাখে মিথ্যা এবং যাবতীয় গুণাহ থেকে। প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকো। রোযার দিনটিতে তুমি ভাবগম্ভীর ও প্রশান্ত থাকার চেষ্টা কর। রোযার দিনটি এবং রোযা ছাড়া দিনটি যেন তোমার একই রকম না হয়ে যায়’।
মোদ্দাকথা, দেহ এবং আত্মা উভয়ে মিলে যে রোযা রাখে সেটাই হচ্ছে প্রকৃত রোযা। সে রোযার মাধ্যমেই আল্লাহর কাছ থেকে অর্জিত হবে অফুরন্ত মাগফিরাতের সুসংবাদ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রামাদ্বান মাসের রোযা রাখে তার সকল গুণাহ মাফ করে দেয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রামাদ্বান মাসে রাতে ইবাদতে মশগুল থাকে, তার সকল গুণাহ মাফ করে দেয়া হয়।-(বুখারী/মুসলিম)।
ঈমান ও ইহতিসাব দ্বারা বুঝানো হয়েছে-রোযাকে আল্লাহ যে ফরয করেছেন তার সতেজ উপলব্ধি সহকারে তা পালন করা। আল্লাহর কাছ থেকে অফুরন্ত পুরস্কারের প্রবল আকাক্সা সহকারে পালন করা। রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার কুমন্ত্রণা থেকে দূরে থাকা। শুধু গৎ বাঁধা অভ্যেস হিসেবে নয়, বা সবাই যেহেতু রোযা রাখবে কাজেই আমারাও না রেখে গতি নেই। অথবা পেট উপোষ রাখলে স্বাস্থ্যবিদদের দৃষ্টিতে অনেক ফায়দা আছে-এসব কিছুর কারণে নয়, সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর হুকুম পালনের পরাকাষ্ঠা নিয়ে। সিয়াম সাধনার এ নির্ভেজাল রূপটির নাম হচ্ছে ঈমান ও ইহতিসাব।
ক্বিয়ামুল্লাইল অর্থাৎ তারাবীহ এবং তাহাজ্জুদও অনুরূপভাবে ঈমান ও ইহতিসাবের সহিত আদায় করতে হবে। ঘন ঘন করে কতকগুলো রুকু সিজদা দিয়ে অনেকগুলো রাকয়াতের ফিরিস্তি তৈরি করা ক্বিয়ামুল্লাইলের সার্থকতা নয়। সার্থকতা হচ্ছে খুশু খুযুসহ ভাবগম্ভীর পরিবেশে দীর্ঘ ক্বিয়ামে তৈরি করা ক্বিয়ামুল্লাইলের সার্থকতা নয়। সার্থকতা হচ্ছে খুশু খুযুসহ ভাবগম্ভীর পরিবেশে দীর্ঘ ক্বিয়ামে লম্বা কিরাত ও সময় নিয়ে ধীর স্থিরভাবে রুকু সিজদা করে আল্লাহর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ গ্রহণ করা। খতম তারাবীহ হলেই হবে না।
কুরআনকে অবশ্যই তাজবীদ সহকারে হৃদয়ঙ্গম করে তিলাওয়াত করতে হবে। চাই খতম হোক আর না হোক। রকেটের গতিতে কুরআন খতম এবং খতম তারাবীর এ নি®প্রাণ রেওয়াজ অনেকের কাছে একটা ঠুনকো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ক্বিয়ামুল্লাইরৈর প্রাণ এবং আল্লাহর কালামের তেলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য তাতে হারিয়ে গেছে। মযলুম তেলাওয়াতের শিকার ও কুরআন কিয়ামতের দিন সুপারিশ করা তো দূরে, বরং তিলাওয়াতকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করে বসবে।
আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের প্রত্যাশায় রামাদ্বানের রোযা, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ এবং কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি আরেকটি নেক আমলকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আদায় করতে হবে। আর সেটি হচ্ছে দান খয়রাত ও রাসুলুল্লাহ (সা.)এ আমলটিকে রামাদ্বানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। বুখারী ও মুসরিম গ্রন্থদ্বয়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘নবীজি (সা.) ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল’। আর রামাদ্বান মাস এলে হযরত জিবরাঈল (আ.) যখন তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন, তাঁকে নিয়ে কুরআন পাঠের অনুশীলন করতেন, তখন তিনি আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। হযরত জিবরাঈল (আ.) রামাদ্বানের প্রতিটি রাতেই নবীজি (সা.)-এর সাথে সাাত করতে আসতেন। কুরআন পাঠের অনুশীলন করতেন।
জিবরাঈল (আ.)’র সাথে সাাতের সময়গুলোতে তিনি মেঘবাহী বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। অন্য রেওয়াতে এসেছে, কেউ কিছু চাওয়ামাত্র তিনি তা দান করে দিতেন-(আহমদ), কারণ জান্নাতের আকাক্সা থাকরে অবশ্যই আল্লাহর রাস্তায় অবারিতভাবে দান করতে হবে। আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘জান্নাতে এমন কিছু প্রাসাদ রয়েছে যেগুলো এত সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে যে সেগুলোর বাইরে থেকে ভিতরের সবকিছু দেখা যাবে এবং ভিতর থেকে বাইরের সবকিছু দেখা যাবে।
সাহাবায়ে রেরাম জিজ্ঞেস করলেন, কাদের জন্য সে সুযোগ হে আল্লাহর রাসূল (সা.)? তিনি বললেন, ঐসব লোকদের জন্য যারা মিষ্টভাষী, অন্যদেরকে আহার সরবরাহ করে, সর্বদা রোযা পালন করে আর রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়’।-(আহম/ইবনে হাব্বান/রায়হাকী)
রামাদ্বানে উপরোল্লিখিত নেক আমলগুলোর পাশাপাশি আরও যে আমলটার সুযোগ বেশি করে নিতে হবে সেটা হচ্ছে তাওবা এবং ইস্তেগফার। রোযা ও অন্যান্য নেক আমলের কারণে এ মাসে বান্দার প্রতি আল্লাহর করুণা অনেক বেড়ে যায়। বান্দাও এ মাসে তুলানামূলকভাবে গুণাহ কম করে এবং বেশি করে নেক আমলের কারণে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলে অনেকখানি এগিয়ে যায়।
আর এটাই মোম সময় আল্লাহর মাফ চাওয়ার। রামাদ্বানের প্রথম বিশ দিনের তুলনায় শেষের দশ দিনের আমলকে বাড়িয়ে দিতে হবে। দশ দিনের ঐ বিশেস সুযোগের মধ্যে ই নিহীত রয়েছে হাজর মাসের চেয়েও সেরা লাইলাতুল ক্বাদরের রাতিট। যা লুকিয়ে রয়েছে পাঁচটি বেজোড় রাতের যে কোন একটি রাতে। তাই ঐ পাঁচটি রাতের আমল অবশ্যই অন্য রাতের চেয়ে বেশি হওযা উচিত। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রামাদ্বানের শেষ দশটি দিন এলে রাসূলুল্লাহ (সা.) কোমরে কাপড় বেঁধে নামতেন, রাতে ইবাদতে মশগুল হয়ে যেতেন, পরিবারের অন্যান্যদেরকেও জাগিযে দিতেন।-(বুখারী/মুসলিম)ঃ
অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, তিনি এ দশদিনে এত বেশি আমল করতে না তিনি অন্যান্য সময় করতেন না। -(মুসলিম) লাইলাতুল ক্বাদরকে পাওয়ার জন্যই এ দশদিনে ইতিফাক করতেন এবং এত আমল করতেন। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিছাবের সাথে লাইলাতুল ক্বাদরে ইবাদত করবে তার অতীত গুণাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে।-(বুখারী/মুসলিম) আয়েশা (রা.) জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) আমি যদি লাইলাতুল ক্বাদর পাই তাহলে কোন দোয়া বেশি পড়বো?
তিনি বললেন, বলো, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।-(তিরমিযী) অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি মাশীল, মা করাকে আপনি খুবই পছন্দ করেন, অতএব আমাকে মাফ করে দিন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রামাদ্বানের এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন। আমীন!
লেখক: মাওলানা শায়েখ আব্দুল কাইয়ূমঃ, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও খতিব ইস্ট লন্ডন মসজিদ