নিউজ ডেস্ক: আইএস বাংলাদেশে চারটি হামলার দায় লিখিতভাবে স্বীকার করেছে। আইএসের অনলাইন ম্যাগাজিন দাবিক-এ প্রকাশিত এক লেখায় দুই বিদেশী হত্যা, সাভারে পুলিশ সদস্য হত্যা এবং শিয়াদের মিছিলে হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে আইএস আখ্যা দিয়েছে মুরতাদ হিসেবে। দাবিক-এর ১২তম সংস্করণে বাংলাদেশ নিয়ে ৫ পৃষ্ঠার ওই নিবন্ধের শিরোনাম হচ্ছে দ্য রিভাইভ অব জিহাদ ইন বেঙ্গল।
লেখক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আবু আবদির রহমান আল-বাঙালি’র নাম। নিবন্ধে বলা হয়, ১৪ই জিলহজ ১৪৩৬ (২৮শে সেপ্টেম্বর) তারিখে বেঙ্গলে খিলাফত সেনাদের একটি সিকিউরিটি সেল গুলশানের রাস্তায় সিজার তাভেলা নামের ক্রুসেডার ইতালিয়ানকে হত্যা করে।
একে মহান কাজ উল্লেখ করে বলা হয়, এতে ওই ভূখণ্ডের সীমালঙ্ঘনকারী (তাওয়াগিত) আর ক্রুসেডারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়। কেননা, ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায়। যা কিনা দেশের তথাকথিত সব থেকে নিরাপদ আবাসিক এলাকা।
কয়েকদিন পর ১৯শে জিলহজ (৩রা অক্টোবর) আরেকটি সিকিউরিটি সেল রংপুরে একজন জাপানি নাগরিককে টার্গেট করে। পর পর এসব হামলা বেঙ্গলে বসবাসকারী ক্রুসেডার রাষ্ট্রের নাগরিক ও তাদের মিত্রদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়। এতে তাদের কূটনীতিক, পর্যটক ও অভিবাসীরা চলাচল সীমিত করে দিতে বাধ্য হয়। সার্বক্ষণিক আতঙ্কের মধ্যে দিন যাপন করতে থাকে তারা।
আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, দূরবর্তী অঞ্চলে পরিচালিত এসব হামলায় শক্ত বার্তা দেয়া হয়েছে এবং আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলো আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নাগরিকরা তিউনিসিয়া থেকে বেঙ্গল পর্যন্ত মুসলিম ভূখণ্ডের কোন অংশে কখনই শান্তি বা নিরাপত্তা উপভোগ করবে না।
১০ই মহররম ১৪৩৭ (২৪শে অক্টোবর) আশুরা’র দিনে খিলাফতের সেনারা রাফিদাদের (প্রত্যাখ্যানকারী) ওপর সিরিজ বোমা হামলা চালায়। তারা হোসেনি দালানের সামনে বিরাট এক মিছিলের জন্য সমবেত হয়েছিল। প্রায় ৪০০ বছরের মধ্যে বেঙ্গলের রাফিদাদের টার্গেট করা এটা প্রথম অভিযান। শতাধিক ‘মুরতাদ’ এতে হতাহত হয়। এর দু’সপ্তাহেরও কম সময়ে ২১শে মহররম ১৪৩৭ (৪ঠা নভেম্বর) তারিখে ঢাকায় একটি তল্লাশি চৌকি প্রস্তুত করার সময় এক দল পুলিশ সদস্যের ওপর সাহসী অভিযান চালায় ‘মুজাহিদীনরা’। তারা একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আর আহত করে চারজনকে।
এসব হামলার দায় স্বীকার করে নিবন্ধে বলা হয়, বেঙ্গলে খিলাফতের সেনারা যখন কুফরের ওপর আরও হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ‘ধর্মনিরপেক্ষ মুরতাদরা’ বিদ্যমান প্রকৃত সত্য বিকৃত করা অব্যাহত রেখেছে। আর তারা বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামীর মুরতাদদের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় দোষারোপ করার খেলা খেলছে।
দাবি করা হয়, এদিকে, আইএস সেনারা বেঙ্গলে তাদের উত্থান আর বিস্তার অব্যাহত রেখেছে। একইসঙ্গে পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘ক্রুসেডার’ ও তাদের মিত্রদের ওপর ত্রাস সৃষ্টি অব্যাহত রাখা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।
নিবন্ধের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, কয়েক মাস ধরে গ্রেপ্তারের পর আইএসের ‘শীর্ষ সমন্বয়ক’কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে একাধিকবার মিথ্যা দাবি করে সরকার। এরপর সিজার তাভেলা হত্যার পর ‘নির্লজ্জ, মিথ্যাবাদী, মুরতাদ সরকার’ জনসমক্ষে বলে ‘বাংলাদেশে কোন আইএস নেই’। খেলাফতের সেনাদের প্রতিটি অভিযানের পর তারা ভাঙা রেকর্ডের মতো বার বার একই মিথ্যার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। আন্তর্জাতিক কুফর সম্প্রদায়ের সামনে মুখ রক্ষা করতে আর ক্রুসেডার রাষ্ট্রের নাগরিক ও রাফিদি নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা লুকানোর মরিয়া প্রচেষ্টায় তারা এটা করেছে।
বাংলাদেশ সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, মুরতাদ সরকার দ্রুতই উপলব্ধি করবে যারা নির্লজ্জভাবে সত্য অস্বীকার করছে। ‘বিরোধী মুরতাদদের’ সঙ্গে দোষারোপের শিশুতোষ খেলা খেলে কোনই লাভ হবে না। কেননা, আইএস এখানে থাকতে এসেছে। আইএস শাম (সিরিয়া) ও ইরাকে থাকতে এসেছে। খুরাসান ও কাওকাজে থাকতে এসেছে। আর মুরতাদরা অবজ্ঞা করলেও আইএস তিউনিসিয়া থেকে বেঙ্গল পর্যন্ত থাকতে এসেছে।
নিবন্ধের প্রথম অংশে আইএসের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ‘জিহাদে’র অতীত ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়। এতে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীনকে প্রশংসা করা হয়। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমানকে ‘শহীদ মুজাহিদ’ আখ্যা দেয়া হয়। বলা হয়, মুরতাদ সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে তার আরও কিছু মুজাহিদ কমান্ডারসহ মৃত্যুদণ্ড দেয় ২০০৭ সালে।
এর আগের সরকারে ছিল বিএনপি ও জামায়াতের ‘মুরতাদদের’ জোট। জামায়াতকে বলা হয়, উপমহাদেশের তথাকথিত মুসলিম ব্রাদারহুডের ভারতীয় সংস্করণ। আর জামায়াত প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর একটি ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের ‘মুরতাদ প্রধান’।
বলা হয়, কয়েক বছরের মধ্যেই উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা এবং ‘তাগুত’ বাহিনীর অনেক কমান্ডার ‘মুরতাদ’ বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের এক বিদ্রোহে নিহত হয়, যাদের অনেকে ‘মুজাহিদ স্কলারদের’ (জেএমবি জঙ্গি) মৃত্যুদণ্ডে জড়িত ছিল। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ‘মুরতাদরা’ যারা কিনা ‘মুজাহিদ স্কলারদের’ মৃত্যুদণ্ডের আহ্বান জানিয়েছিল, আনন্দ করেছিল এবং সক্রিয়ভাবে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিল- সেই একই মুরতাদরা অবমাননার শিকার হয়েছে, তাদের টেনে হিঁচড়ে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাবজ্জীবন এবং মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ওই একই ‘তাগুত’ আদালত। এদের কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের ‘তাগুত’ সরকার কার্যকর করেছে।
উল্লেখ্য, আইএসের অনলাইন ম্যাগাজিন দাবিক-এ প্রকাশিত এই নিবন্ধকে উদ্ধৃত করে গতকাল খবর প্রকাশ করেছে জাপান টাইমস। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবারও হোশি কুনিও হত্যার দায় স্বীকার করলো আইএস। এদিকে, সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের পরিচালক রিটা কাট্জ দাবিক-এ প্রকাশিত বাংলাদেশবিষয়ক নিবন্ধ নিয়ে টুইট করেছেন।
ওদিকে, ইতালিয়ান পাদ্রি পিয়েরো পারোলারিকে হত্যাচেষ্টা সহ বাংলাদেশে তিনটি হামলার দায় আইএস স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী জিহাদি সংগঠনগুলোর ওপর নজরদারিমূলক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির টুইটার পাতায় এক টুইটে বলা হয়েছে, আইএস-সংশ্লিষ্ট ‘আমাক নিউজ’ বাংলাদেশে ইতালিয়ান পাদ্রির ওপর আইএস যোদ্ধাদের হত্যাচেষ্টার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আরেকটি টুইটে বলা হয়েছে, ইতালিয়ান পাদ্রি পিয়েরো পারোলারিকে হত্যাচেষ্টা এবং রংপুরে বাহাই সমপ্রদায়ের নেতা রুহুল আমিনকে হত্যাচেষ্টা ও স্থানীয় মাজারের খাদেম রহমত আলীকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস। এ সংক্রান্ত একটি ছবিও টুইটে সংযুক্ত ছিল। সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপের প্রধান রিটা কাট্জও গতকাল টুইটারে একই বার্তা দেন।
দ্বিতীয় আরেকটি টুইটে তিনি মন্তব্য করেন, ২৯শে সেপ্টেম্বরের পর পিয়েরো পারোলারি বাংলাদেশে তৃতীয় বিদেশী যাদের (হত্যা বা হত্যাচেষ্টার) দায় আইএস স্বীকার করেছে। এতে দেশটি এ ধরনের হামলার উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে।