তাইছির মাহমুদ: পূর্ব লন্ডনের ক্যানন স্ট্রিট রোডের একটি সলিসিটর্স ফার্মের কর্ণধার একাধিক গ্রাহকের প্রায় মিলিয়ন পাউন্ড হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছেন। তাঁর নাম মুহাম্মদ জাহির উদ্দিন। তিনি ইওর রাইট সলিসিটর্স লিমিটেড এর স্বত্বাধিকারী ছিলেন। এ ঘটনায় কমিউনিটিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
সলিসিটর জাহির উদ্দিনের উধাও হওয়ার খবরে ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা অফিসে ভাংচুর চালিয়েছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২৪ অক্টোবর মঙ্গলবার সলিসিটর রেগুলেটরী অথরিটি (এসআরএ) জাহির উদ্দিনের অফিস সিলগালা করে দিয়েছেন। পুলিশ সারাদেশে সার্কুলার জারি করেছে।
সলিসিটর জাহির যাতে ব্রিটেন থেকে বের হতে না পারেন এ জন্য বিমানবন্দরসহ সকল বোর্ডারকে অবগত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জাহির উদ্দিনের মালিকানাধীন ইওর রাইট সলিসিটর্স ফার্মের দুইটি অফিস ছিলো। প্রধান অফিস ছিলো ১৬৭ ক্যানন স্ট্রিট রোডের প্রথম তলায়। আর দ্বিতীয় শাখা অফিসটি ছিলো ৭৩২ রমফোর্ড রোডে।
উক্ত শাখা অফিসের গ্রাহক ছিলেন পূর্ব লন্ডনের ম্যানর পার্কের বাসিন্দা প্রাইস ওয়াটারকুপার হাউজের সিনিয়র ট্যাক্স কনসালটেন্ট জাকির হোসেন আহাদ। তিনি একটি ঘর ক্রয়ের জন্য উক্ত ফার্ম থেকে আইনি সহায়তা নিচ্ছিলেন।
তিনি গত ১৮ নভেম্বর বুধবার ইওর রাইট সলিসিটর্স ফার্মের ব্যাংক একাউন্টে ২৪৩ হাজার পাউন্ড ট্রান্সফার করেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে এই অর্থ ফার্মের একাউন্টে পৌঁছে। ২০ নভেম্বর শুক্রবার ট্যাক্স ম্যাসেজ দিয়ে তাঁকে নিশ্চিত করা হয় যে, তাঁর অর্থ ফার্মের একাউন্টে জমা হয়েছে এবং ওইদিন ঘর বিক্রেতার মনোনীত সলিসিটর ফার্মের একাউন্টে ট্রান্সফার করা হবে।
কিন্তু তিনি ঘর বিক্রেতার আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন এখনও অর্থ জমা হয় নি। ২৩ নভেম্বর সোমবার সকালে ফোন করেও জানতে পারেন তখনো অর্থ ট্রান্সফার হয়নি। তখন তিনি রমফোর্ড অফিসে যান এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে কারণ জানতে চান। উক্ত অফিসের কর্মকর্তারা তাকে নিয়ে ক্যানন স্ট্রিট রোডের হেড অফিসে এসে দেখেন এখানে কেউ নেই। অফিস বন্ধ। ফোনে সলিসিটর জাহির উদ্দিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।
কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়ে জাহির উদ্দিনের সন্ধান না পেয়ে একাউন্ট চেক করতে ব্যাংকে যান। কিন্তু তারা একাউন্ট হোলডার না হওয়ায় ব্যাংক তাঁদেরকে তথ্য প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে। এরপর তারা বেথনাল গ্রীন পুলিশ স্টেশনে গিয়ে অভিযোগ করেন।
এদিকে ভুক্তভোগী জাকির আহাদ গ্রীন স্ট্রিট পুলিশ স্টেশনে গিয়ে অভিযোগ করতে চাইলে পুলিশ তাঁকে জানায় ইতোমধ্যে জাহির উদ্দিন সম্পর্কে পুলিশের সকল নেটওয়ার্কে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সলিসিটর জাহির তার ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে বৃটেন থেকে বেরিয়ে গেছেন বলে কোনো রেকর্ড নেই। তবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বেরিয়ে গেলে সে তথ্য তাদের কাছে নেই।
ইওর রাইট সলিসিটর্স অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে জাকির আহাদ ছাড়াও আরও ৩ জন গ্রাহকের মোটা অংকের অর্থের লেনদেন প্রক্রিয়াধীন ছিলো। এছাড়া ছোট খাটো আরো অনেক লেনদেন ছিলো। ধারণা করা হচ্ছে কমপক্ষে এক মিলিয়ন পাউন্ড নিয়ে তিনি উধাও হয়েছেন।
সলিসিটর জাহিরের দেশের বাড়ি বাংলাদেশের ভোলা জেলায় বলে জানা গেছে। তার পিতা আশির দশকে সিলেটের বিশ্বনাথ থানার ওসি ছিলেন। জাহির উদ্দিন তখন বিশ্বনাথে বসবাস করতেন এবং স্থানীয় রামসুন্দর হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, সলিসিটর ফার্ম বৈধভাবে পরিচালনা করতে ইনডেমনিটি ইন্স্যুরেন্স করা অপরিহার্য। অক্টোবর মাসে ইন্স্যুরেন্স নবায়ন করতে হয়। যেহেতু এই ইন্স্যুরেন্স বেশ ব্যয়বহুল তাই জাহির উদ্দিন তার ফার্মের ইন্সুরেন্স নবায়ন নাও করতে পারেন। ইন্স্যুরেন্স না থাকলে গ্রাহকদের খোয়া যাওয়া অর্থ ফিরে পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
২৫ নভেম্বর বুধবার বিকেলে এই প্রতিবেদক ক্যানন স্ট্রিট রোডস্থ ইওর রাইট সলিসিটর্স অফিসে গিয়ে দেখেন, সেখানে কেউ নেই। দুই রুমের ফার্মের সবগুলো রুমই তালাবদ্ধ। রিসেপশন ডেস্কে একটি কম্পিউটার ও কেবিনেটে কিছু ফাইলপত্র রয়েছে।
একই ভবনের দ্বিতীয় তলার একাউন্টেন্ট ফার্মের একজন কর্মকর্তা জানান, সোমবার থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ সলিসিটর জাহির উদ্দিনকে খুঁজছেন। কিন্তু কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে সে বাংলাদেশ পালিয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে পূর্ব লন্ডনের লিংকন চেম্বারর্স সলিসিটর্স এর স্বত্বাধিকারী বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, এই মুহূর্তে ভূক্তভোগী গ্রাহকদের আইনের আশ্রয় নেওয়া দরকার।
তবে যে কোনো আইনী সহায়তার জন্য কমিউনিটিতে সুপরিচিত ও নির্ভরযোগ্য সলিসিটর্স ফার্মের কাছে যাওয়া উচিত। সলিসিটর জাহির উদ্দিন কমিউনিটিতে অপরিচিত ছিলেন। তাকে কেউ চিনতো না। তাই তার পক্ষে মিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাত করে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইতোঃপূর্বে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসায় আকস্মিকভাবে গ্রাহকের হাজার হাজার পাউন্ড হাতিয়ে নিয়ে উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ক্বিবলাহ হজ্জ কাফেলার ডাইরেক্টর ফারুক আহমদ হজ্জযাত্রীদের হাজার হাজার পাউন্ড হাতিয়ে বাংলাদেশ পালিয়ে যান। কিন্তু বাংলাদেশে পালালে তিনি বাঁচতে পারেন নি। বৃটিশ পুলিশ তাকে বাংলাদেশ থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে।
পরবর্তীতে তার সাজা হয়। ভুক্তভোগীরা আশাবাদী, ব্রিটিশ পুলিশ জাহির উদ্দিনকে গ্রেফতার করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ব্রিটেনে গা ঢাকা দিলে তাকে খোঁজে বের করবে আর বাংলাদেশে পালিয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।