শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২

কঠিন চ্যালেঞ্জ, যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন খালেদা রাজনীতিতে নানা ছক ও খালেদার কঠিন সিদ্ধান্ত

কঠিন চ্যালেঞ্জ, যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন খালেদা রাজনীতিতে নানা ছক ও খালেদার কঠিন সিদ্ধান্ত

জঙ্গিবাদ ইস্যুর আড়ালেও রাজনীতির অন্ধরমহলে চলছে নানা হিসাবনিকাশ। কিছুদিন থেকে দেশে ধারাবাহিক হত্যা আর জঙ্গি তৎপরতা বিষয়ে সরকার যে বেশ চাপের মুখে পড়েছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।সরকারি মহল এ কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করুক কিংবা নাইবা করুক, তারা যে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে তা তাদের কথাবার্তা আর চালচলনেও প্রতীয়মান।এমন কি ক’দিন আগে সংবাদ সম্মলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভয়বেও সেটা দৃশ্যত হয়েছে।

ফলে এই অস্বস্তি কাটাতে সরকারি মহলে চলছে নতুন কৌশল, খুঁজছে নানা পথ। এরই অংশ হিসেবে হয়তো বিরোধীদের উপর নতুন করে দমন-নিপীড়ন শুরু হয়েছে।যা কয়েকদিনের সরকারের ধরপাকড় আর বক্তব্য-ভাষ্য থেকেও প্রতীয়মান হয়েছে।

অন্যদিকে, বিএনপিও নতুন করে বেশ চাপের মুখে পড়েছে।লন্ডন সফররত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা না ফেরা নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ বইছে।প্রধান দুই দলের নেতারা এ নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন।ইতোমধ্যে বেগম জিয়া সাতদফা পিছিয়েছেন তাঁর দেশে ফেরার কর্মসূচি।এখন আর নতুন করে কোনো সিডিউলের কথাও শোনা যাচ্ছে না।

ফলে বিষয়টি রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।প্রশ্ন দেখা দিয়েছে খালেদা জিয়া কি সহসাই দেশে ফিরছেন, না ফিরছেন না। ফিরলে কি লাভ, আর না ফিরলেই বা রাজনীতিতে কতটা ক্ষতি।সে হিসাবও কষে দেখছেন খালেদা জিয়া। যতদূর জানা গেছে এ নিয়ে খোদ বিএনপিতেই পরস্পর বিরোধী মত রয়েছে।

বিএনপির বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবীদের মধ্যে একটি অংশ চান খালেদা জিয়া লন্ডনে থাকলেই এখন ভাল হয়।সেখানে থাকলে যেমনটি সরকারের হয়রানি এড়ানো সম্ভব হবে তেমনি দলও লাভবান হবে।অপর অংশটি চাচ্ছেন, বেগম জিয়া লন্ডনে থেকে গেলে রাজনীতি ও জনগণের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। এতে সার্বিক বিবেচনায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে সরকারও চাচ্ছে খালেদা জিয়া লন্ডনেই থেকে যাক।তাদের সাম্প্রতিক কথা বার্তা থেকেও এমনটিই লক্ষ্য করা গেছে।যেমনটি উল্লেখ করা যেতে পারে, সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা খুব শিগগিরই শেষ হবে।এতে কী হবে খালেদা জিয়া বুঝতে পারছেন।তাই তিনি দেশে ফিরবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে।’

এছাড়াও নৌমন্ত্রী শাজাহান খানসহ আরো বেশ কয়েকজন আ’লীগ নেতা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ফলে সরকারের এমন কামনা থাকলেও বিকল্প চিন্তাও করা হচ্ছে।যেমনটি মামলাগুলো বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার।এমতাবস্থায় খালেদা জিয়া দেশে ফিরে গেলে আদালতের ঘারে বন্দুক রেখেই যতদ্রুত সম্ভব তাকে কারাগারে পাঠানো। সরকারের এই প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার ৩টি মামলা ইতোমধ্যেই বিচারের জন্য একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

তবে যে যাই বলুক না কেন, এই সময়টা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য খুবই দুঃসময়।জীবনে অনেক পরিস্থিতি মোকাবেলা করলেও বর্তমানের মতো এমন প্রতিকূলতায় আর কখনও পরেছেন বলে আমার জানা নেই।তাই এখন দেখার বিষয় তিনি কতটা বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেন।

ঢাকা ও লন্ডনের বিভিন্ন সূত্রে যতদূর জানা যাচ্ছে তাতে, বিএনপির কোনো পক্ষেরই কথায় আর কান দিচ্ছেন বেগম জিয়া।নিজের বুদ্ধিতে পথ চলার চেষ্টা করছেন।বর্তমানে দেশে ফেরা না ফেরা নিয়ে উভয় সঙ্কটে রয়েছেন।তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথেই সলাপরামর্শ করছেন তিনি। ভাবছেন কী করবেন!ফলে আরো কিছুদিন লন্ডনে অবস্থান করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে এমনটিই জানা যাচ্ছে।

ফলে পর্যবেক্ষক মহলেও এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা কৌতূহল।দলের নেতা-কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা অধীর আগ্রহে বেগম জিয়ার দেশে ফেরার অপেক্ষা করছেন।তার অনুপস্থিতিতে তৃণমূলে দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায়ও কিছুটা ভাটা পড়েছে।তবে বিএনপি ও জামায়াত ঘরনার বুদ্ধিজীবীদের বাইরে তৃতীয় পক্ষেরও এ নিয়ে ভাবনা থেমে নেই।দলীয় গন্ডির বাইরের বুদ্ধিজীবী ও পর্যবেক্ষকরাও এই পরিস্থিতিকে খালেদা জিয়ার জন্য বেশ জটিল ও প্রতিকূল হিসেবেই মনে করছেন।

এমতাবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া যা করতে পারেন-

পুরানো ৫টি মামলার মধ্যে ম্যাডাম জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মামলার বিচার কাজ বর্তমানে প্রায় শেষ পর্যায়ে।স্বল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো এসব মামলার রায় হবে। এতে কী ধরনের সাজা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।এছাড়াও নাশকতার অভিযোগে সারাদেশে করা ১২০টি মামলার মধ্যে ৫টি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। ওইসব মামলায়ও তাকে আসামি করে চার্জশিট দেয়া হচ্ছে।দু’একটি মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে।ফলে সামনে সরকারের মোটিভ কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

বিএনপি ঘরনার লোকজনদের কাছে আমার আজকের এই বিশ্লষণ তিক্ত মনে হলেও বাস্তবতার চরম সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

এমতাবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার সামনে দুটি রাস্তা খোলা আছে।

এক. দেশে ফিরে আইনীভাবে মামলারগুলোর মোকাবেলা করে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার চেষ্টা করা।সেই সাথে কারাগারে যাওয়ার মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়া।

দুই. অগণতান্ত্রিক জুলুমবাজ সরকারের হয়রানি এড়াতে লন্ডনে থেকে রাজনীতিতে টিকে থাকা।এবং দলের নেতাকর্মিদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নেয়া।

কোনটি তার জন্য বেশি সমীচীন সেটি নিয়েও অনেকের মধ্যে মতবিরোধ থাকতেই পারে।তবে পর্যবেক্ষক মহলের মতে, জলোচ্ছ্বাস কিংবা মহাপ্লাবনের বিরুদ্ধে অযথা শক্তি প্রয়োগের কোনো অর্থ হয় না। বরং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অধিকতর ক্ষতি এড়ানোই শ্রেয়। ফলে প্রতিকূল রাজনীতিতে যেখানে বর্তমান সরকার কোনো গণতান্ত্রিক কিংবা আইনী ভাষা বুঝে না, মানবাধিকার বুঝে না, দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সনদ কিংবা মূল্যবােধ মানে না। সেখানে খালেদা জিয়ার অধিক সাহস দেখানো কতটা দলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে সেটা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়।

অনেকের মতে, অগণতান্ত্রিক পরিবেশে অধিকতর সাহস দেখিয়ে কারাগারে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।এমতাবস্থায় বেগম জিয়া কারান্তরীণ হলে দল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।ফলে তিনি যেখানেই অবস্থান করেননা কেন, মুক্ত অবস্থায় দলের নেতাকর্মিদের দিকনির্দেশনা দিয়ে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকাই এখন জরুরী।

কেননা, এ ধরনের বহু নজীর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিকবিদদের ক্ষেত্রে রয়েছে।খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।আমাদের প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানের বেনজির ভেুট্টোর কথা তো সবারই জানা।তিনি কিভাবে লন্ডন-অ্যামেরিকায় থেকে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন।এছাড়াও তুরস্ক-ইরানেও যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল সেটার প্রেক্ষাপটও প্রায় একই ধরনের ছিল।

তাই এখন দেখার বিষয় খালেদা জিয়া কোন পথে হাঁটেন। ১৯৮১ থেকে ২০১৫ এই ৩৫ বছরে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে জিয়া পরিবারকে।এরশাদের শাসনামলে ’৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় তাকে চরম জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়।অতঃপর ২০০৭ সালের ১/১১ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সময় তাকে কারাগারে যেতে হয়। এরপরও খালেদা জিয়া এমন একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিক। কখনো ক্ষমতায় থেকেছেন আবার কখনো বিরোধী দলে থেকেছেন।

কিন্তু বর্তমানে তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো পদে নেই, নেই সংসদেও। না থাকলে কী হলো, দেশের জনপ্রিয় দলগুলোর অন্যতম বিএনপির চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোটনেত্রী। দেশের মানুষের ‘ভোটের অধিকার’ আদায়ের দাবিতে তার নেতৃত্বে চলছে ৯ বছর ধরে আন্দোলন।মূলত জনগণকে ঘিরেই তার সব কিছু।

সবমিলেই এখন রাজনীতিতে টিকে থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে ম্যাডাম জিয়ার জন্য।রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।অতীতে চাটুকররা প্রশংসার বুলি উড়িয়ে নিজেরাই ম্যাডামকে ঘিরে রাখে, এতে মাঠের নেতাকর্মি ও সাধারণ জনগণ কী ভাবছেন সেটা জানা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় ম্যাডামকে।

এছাড়া দলের প্রভাবশালী নেতারাও নিজেদের ও সম্পদ রক্ষায় সরকারের সাথে গোপন আঁতাতে ম্যাডামকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করেছেন।ফলে ম্যাডামকে এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজেকেই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েঁছে।

সবশেষে বলবো মামলা মোকাবেলার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ায় ম্যাডামের বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ আন্দােলনের ফল ঘরে তুলতে হলে তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এতে সরকার ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা যাই বলুক না কেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিজয়ী হলে সব কিছুই একদিন মুছে যাবে।ফলে দল এবং দেশের স্বার্থেই ম্যাডামকে এখন বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগুতে হবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আগামী দিনে ম্যাডাম কোন পথে হাটেঁন সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায় দেশবাসী।

লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান। কলাম লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: sarderanis@gmail.com




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024