পিন্টু দেবনাথ: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে প্রভা রানী মালাকার ও আরিনা বেগম রাজাকার ও পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের খোঁজ কেউ রাখছেনা। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি আজও পাননি এই দুই মহিলা। ভিটে মাটি ছাড়া অসহায় অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বুকে লালিত অনেক স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন।
বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু কেউ এব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। প্রভা রানী মালাকার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের মৃত কামিনী রাম মালাকারের স্ত্রী প্রভা রানী মালাকার। বৈশাখ মাসে তার বিয়ে হয় আর শ্রাবন মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন স্বামী কামিনী রাম মালাকার চলে যান ভারতে।
তিনি চলে যান বাবার বাড়ী পাশ্ববর্তী গ্রাম বিক্রমকলসে। মাস পনের দিন পর বিক্রম কলস গ্রামের একদিন গোধুলী লগ্নে প্রভা রাণীকে তার মায়ের সামনে থেকে জোর পূর্বক তুলে নিয়ে যায় পাশ্ববর্তী বাদল মাষ্টারের বাড়ী। তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন দৌড়ে পালাবেন কিন্তু তাদের হাতে বন্দুক থাকায় গুলিতে মরে যাওয়ার ভয়ে আর পালাননি। যেখানে পাকিস্তানী আর্মিরা অবস্থান নিয়েছিল। সে রাতে বাদল মাষ্টারের বাড়ীতে অবস্থান নেয়া সকল আর্মি কেড়ে নেয় তার ইজ্জত। পরদিন সকালে আর্মিরা তাকে ছেড়ে দিলে তিনি আশ্রয় নেন তার বোনের বাড়ী জাঙ্গাল হাটি গ্রামে। সেখানে কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকেন। কিন্তু বিধি বাম ২০/২৫ দিন পর স্থানীয় রাজাকাররা আবার পেয়ে যায় তার সন্ধান।
শত চেষ্টা করেও প্রভা রানী তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। যে দিন রাজাকাররা জাঙ্গাল হাটি প্রভা রানীর বোনের বাড়ী হানা দেয় তখন নিজেকে রক্ষার জন্য প্রভা রানী ধানের বীজের জমির আইলের নীচে আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাজাকাররা সেখান থেকে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে। তখন প্রভা রানীর বোন বাঁধা দিলে তার মাথায় রাজাকারদের হাতে থাকা লাইট দিয়ে আঘাত করা হয়। এ সময় স্থানীয় গফুর মিয়া তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসায় তিনিও তাদের হাতে লাঞ্চিত হন।
রাজাকাররা প্রভা রানীকে ধরে নিয়ে আসার সময় তাদের পালিত কুকুর তার কাপড় ধরে টানতে থাকে। সোনারার দিঘির পার পর্যন্ত কুকুরটি আসার পর সেটিকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এক সময় প্রভা রানীকে নিয়ে আসা হয় শমশেরনগর ডাক বাংলোয়। যেখানে ছিল পাকিস্তানী আর্মিদের ক্যাম্প। সারা রাত পাকিস্তানী আর্মিরা তাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষন করে। নিজেকে বাঁচানোর সকল চেষ্টা করেও তিনি রক্ষা পাননি। অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন আর্মিদের নিকট কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন প্রভা রানী। সারা রাত তাকে কঠোর নির্যাতনের পর সবাই চলে গেলে তিনি কোন রকম বোনের বাড়ী চলে আসেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর তার স্বামী ভারত থেকে দেশে এসে স্ত্রী প্রভা রানীকে বাড়ী নিয়ে আসতে চাইলে তিনি রাজি হননি। স্বামীর নিকট সব খুলে বলেন। স্বামী তখন উত্তরে বলেছিলেন তোমার মতো হাজার হাজার নারী ইজ্জত দিয়েছে দেশের জন্য। তুমি তাদের একজন। আমার কোন দুঃখ নেই। এক পর্যায় প্রভা রানী চলে যান স্বামীর বাড়ী।
দেশ স্বাধীন হবার এক বছর পর তার এক ছেলের জন্ম হয়। কিন্তু সেই ছেলেকে এক ধরনের নরপশুরা পাঞ্জাবির ছেলে হিসেবে ডাকে। অনেক মানুষ প্রভা রানীকেও ডাকে পাঞ্জাবির বউ বলে। আক্ষেপ করে প্রভা রানী বলেন, এলাকার মানুষের নিকট মুখ দেখানো যায় না। তার ছেলে কাজল মালাকার পেশায় একজন রিক্সা চালক। তাকে মানুষ কটাক্ষ করে। গ্রামের সহজ-সরল মহিলা প্রভা রানী জানেনই না মুক্তিযুদ্ধের সময় যে নারী ইজ্জত দিয়েছেন সরকার তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছেন। তাই তিনি কোথাও কোন সময় প্রকাশ করেননি নিজের অবস্থানের কথা।
আজও বীরাঙ্গনা খেতাব পাওয়ার জন্য আবেদন করেননি প্রভা রানী। স্বামী মারা যাওয়ার পর দু’বেলা দু’মুটো ভাত খাওয়ার জন্য প্রভা রানী বেচে নেন ফেরী করার কাজ। নিজের মাথার উপর টুকরী রেখে গ্রামে গ্রামে তিনি বিক্রি করছেন বিভিন্ন জিনিস পত্রাদি। এক সময় তার ছেলে কাজল মালাকার বিয়ে করে। বর্তমানে তার ৬ মেয়ে। ৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে একবার খেলে আরেকবার না খেয়ে থাকতে হয় তাদের। প্রভা রানী মালাকার মুক্তিযুদ্ধের সময় ইজ্জত হারানো কথা বর্ণনাদেয়ার সময় বার বার মূছা যাচ্ছিলেন।
এরকম করুণ দৃশ্য যে কেউ দেখলেই অবশ্যই চোখের জলে বুক ভাসবে। সাংবাদিকরা লেখালেখি করলে সম্প্রতি ব্যক্তি ও সংস্থার উদ্যাগে কিছু অনুদান পেয়েছেন তিনি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হলেও প্রভা রানীর কথা কেউ স্মরণ করে না। প্রভা রানী মালাকার পাবে কি বীরাঙ্গার স্বীকৃতি?
আরিনা বেগম: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের বড়চেগ গ্রামের আওয়ামীলীগের একনিষ্ট কর্মী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোতালিব মিয়ার স্ত্রী আরিনা বেগম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ তখন ২৫শে অক্টোবর রাতে পরিবারের লোকজনের সাথে শেষবারের জন্য দেখা করতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা মোতালিব মিয়া তখনই রাতের আধারে স্থানীয় রাজাকাররা মিলে ঘরের দরজা ভেঙ্গে আটক করা হয় তাকে।
তুলে দেয়া তার স্ত্রী আরিনা বেগমকে হানাদার বাহিনীর হাতে। হানাদারদের হাত থেকে রেহাই পাননি মোতালিবের স্ত্রী আরিনা বেগম। নরপশুরা বাড়ীর সবার সামনে তার স্ত্রী আরিনা বেগমকে জোরপূর্বক বিবস্ত্র করে পর্যায়ক্রমে পাশবিক নির্যাতন চালায়। আরিনা বেগম তখন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এক সময় দেশ স্বাধীন হয়। ৭৯ সালে মোতালিব ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তিনি বিদেশেপাড়ি জমান। কিন্তুু বিধি বাম, সেখানে এক সড়ক দূর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
তিন কন্যা সন্তানের জনক মোতালিব সেই থেকে অদ্যাবধি আর্থিক দৈন্যতার কারনে তার পরিবার পরিজনদের নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করলেও তার ভাগ্যে জোটেনি। আরিনা বেগম জানান অশ্রু সিক্ত হয়ে জানান, দেশের জন্য ইজ্জত হারিয়েছি। সে কথা বুক ফুটিয়ে বলতে পারিনি। আজ স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এসে যদি আমার দিকে নজর দেয় তবে উপকৃত হবো।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার এই স্বাধীন বাংলার মাটিতে হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হচ্ছে। তার পরিবারও অবশ্যই ন্যায় বিচার পাবে। আরিনা বেগম স্বাধীনতা ৪৪ বছর পার হয়েগেলেও আজও বীরাঙ্গনা হিসাবে কোন মূল্যায়ন পাননি। বুকে লালিত অনেক স্বপ্ন নিয়েআজ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জীবনের শেষ বয়সে এসে কি বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পাবেন ?