রবিবার, ২৫ মে ২০২৫, ০৫:১০

কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত যার জীবনের সঞ্চয় ছয় টাকা

কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত যার জীবনের সঞ্চয় ছয় টাকা

পাটনার বাঁকিপুর থেকে যখন খালি পায়ে কলকাতা আসেন, পকেটে ছিলো তার মাত্র পাঁচ টাকা পঁচিশ পয়সা। একেবারে বিনা চিকিৎসায় শৈশবে তার মাতৃবিয়োগ হয়। প্রত্যন্ত অজপাড়াগাঁয়ের দরিদ্র অঞ্চলে মৃত মায়ের শ্রাদ্ধ করার জন্যও এ পরিবারটির আর্থিক সংগতি ছিলোনা।

এতো দরিদ্র ছিলো শৈশবে উনার জীবন। প্রতিদিনের আহার জুটতো না। ক্ষুধা থেকে বাঁচতে সরকারি ঘোড়ার খাবার বিট-গাজর কাঁচা খেয়ে ছয়ভাইবোন মিলে দিন পার করতেন। নিত্য অভাবের সংসারে মায়ের মৃত্যুর পর এক বছর পড়ালেখা বন্ধ থাকার কারণে পরের বছর কোনো রকমে প্রবেশিকা পাশ করেন। মনে মনে শপথ নিলেন- যেভাবেই হোক ডাক্তার হতে হবে। নিজের মাকে বাঁচাতে পারেন নি। অন্য কারো মা যেন চিকিৎসা না পেয়ে এভাবে মারা না যায়।

ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনের প্রতিটি বাঁকই একেকটি রুপকথার মতো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুধু শুনে যেতে ইচ্ছে হয়। এই কিংবদন্তী মানুষটিকে নিয়ে হাজার পৃষ্ঠা অনায়াসে লিখে শেষ করা যায়, তবুও উনার গল্প লিখে শেষ করা যাবেনা।

১৯০৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখার খরচ চালাতে ধনী লোকের বাড়ীতে পরিচারকের কাজ শুরু করেন। সপ্তাহে একদিন ছুটি পেতেন। সেদিন বাড়তি উপার্জনের জন্য শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ট্যাক্সি চালিয়ে রাত পার করতেন। এসবের মাঝেই করলেন প্রথমবার ডাক্তারী চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফেল।

ফেল করা এই ভজনই মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে বিলেত গিয়ে দু’বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস প্রায় একই সঙ্গে অর্জন করে পরবর্তী জীবনে কিংবদন্তীর ডাক্তার হয়েছিলেন। কলকাতা যখন ফিরে আসলেন তখনও উনার পকেটে সেই পাঁচ টাকা। কারণ স্কলারশীপের সবটাকাই উনি দান করে দিয়েছিলেন।

উনার রোগী যেমন ছিলেন ফুটপাতে রাতে শোয়ে থাকা কপর্দকহীন, অনাথ, দরিদ্র, ঠিক তেমনি উনার রোগীদের মধ্যে ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত দেশবন্ধু, মোতিলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী, বল্লভ ভাই প্যাটেল, মাওলানা আজাদ, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টার ক্লেমেন্ট এটলি প্রমূখ।

১৯১৩-১৯৪৮ পর্বে মহাত্মা গান্ধী আঠারো বার অনশন ব্রত পালন করেছিলেন এবং প্রতিবারই এই রুপকথার মতো চিরকুমার ডাক্তার উনার পাশে ছিলেন।

তাঁর আরেকজন প্রিয় রোগী ছিলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুজনার মাঝে ছিলো এক মধুর সম্পর্ক। চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে তিনি কিছু টাকা তোলবার পরিকল্পনা করেন। ছুটে গেলেন কবিগুরুর কাছে। গিয়ে বললেন- ছবিতে দুটো লাইন লিখে দিতে। কবি বললেন, “ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয়। কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল।”

কিন্তু ডাক্তার নাছোড়বান্দা- সকাল, দুপর, সন্ধ্যা বয়ে যায়। কবি আর কিছুই লিখেন না। বারবার দেশবন্ধুর ছবির দিকে চেয়ে থাকেন। লিখতে গিয়ে আর লিখতে পারেন না। অবশেষে লিখলেন- সেই বিখ্যাত অপূর্ব লাইন দুটি। যা আজো মানুষের মুখে মুখে ফিরে।

“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”

ডাক্তার এবার মূখ্যমন্ত্রী হলেন। সবসময়ই সমালোচকের দল ছিলো। চিরকুমার ডাক্তারের চরিত্র নিয়ে শুরু হলো নানা কানাঘুষা। সেই কানাঘুষা কলকাতার দেয়াল লিখনে রুপ নিলো- ‘বাংলার কুলনারী হও সাবধান, বাংলার মসনদে নলিনী বিধান।’

জওহরলাল নেহেরু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউপি’র গভর্ণর হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। কারণ সরোজিনি নাইডু তখন গভর্নর। তাঁর মনে কষ্ট দিতে চাননি। কিছুদিন পর গান্ধীজি রসিকতা করে বললেন, “তুমি গভর্নর হলে না। ফলে তোমাকে ইওর এক্সেলেন্সি সম্বোধন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম।”

সুরসিক ডাক্তার বললেন- “আমার পদবি রায়, আপনি অবশ্যই আমাকে ‘রয়াল’ বলতে পারেন। আর আমি অনেকের চেয়ে লম্বা, সেহেতু আমাকে ‘রয়াল হাইনেস’ বলতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই। আপনাকে মিথ্যাও বলতে হবেনা।”

কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে তারাশঙ্কর সহ অন্যান্য লেখকরা তখন প্রতিবাদ মূখর। গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে কংগ্রেসে। ডাক্তার তখন মূখ্যমন্ত্রী। তিনি সেক্রেটারীকে ধমক দিয়ে বললেন- “তুমি পুলিশকে বলে দাও, এঁদের বাদ দিয়ে সিনেমার পোস্টারে যে সব প্রায় ল্যাংটো মেয়েদের ছবি ছাপে সেগুলো আটকাতে। কোনো লেখককে নয়।”

গান্ধী একবার চিকিৎসা নিতে রাজি নন। কঠিনভাবে তিনি ডাক্তারকে বললেন, “কেন আমি তোমার কথা শুনব? তুমি কি এদেশের চল্লিশ কোটি মানুষকে আমার মতো বিনামূল্যে চিকিৎসা করো?” ওরা চিকিৎসা না পেলে আমি কেনো নিব?

“না গান্ধীজি, সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, কিন্তু মোহনদাস গান্ধীকে চিকিৎসা করার জন্য এখানে আসিনি। আমি এসেছি এমন একজনকে চিকিৎসা করতে যিনি আমার দেশের চল্লিশ কোটি মানুষের প্রতিনিধি।”

জীবনকালে তিনি যত নিন্দা নতমস্তকে গ্রহণ করে গিয়েছেন তারও তুলনা নেই। তাঁর চরিত্র নিয়ে দেওয়াল লিখন ছড়িয়েছে। নিন্দুকরা তাঁকে ঘিরে ধরে কুৎসিত গালাগালি করেছে, এমনকী জামা গেঞ্জি ছিঁড়ে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। যিনি দেশের কাজে একের পর এক সম্পত্তি বন্ধক দিয়েছেন অথবা বিক্রি করে দিয়েছেন, তাঁকে চোর বলা হয়েছে।

১ জুলাই ১৮৮২ সালে শিশু ভজনের জন্ম, আর ১ জুলাই ১৯৬২ সালের একই তারিখে উনার তিরোধান। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন (১ জুলাই) সারা ভারতে “চিকিৎসক দিবস” রূপে পালিত হয়। চিকিৎসার অভাবে যিনি শৈশবে মাকে হারালেন, বলতে গেলে ঘোড়ার খাবার খেয়ে বড় হলেন, অনাথ হিসাবে বেড়ে ওঠে ধনী গৃহে গৃহপরিচারক আর রাতের কলকাতা শহরের ট্যাক্সিক্যাবের স্বল্পকালীন ড্রাইভার ছিলেন সেই লোকটি আর কেউ নন, সবার পরিচিত ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পশ্চিমবঙ্গের রূপকার হিসাবেও তাঁকে অভিহিত করা হয়।

মূখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেতন নিতেন মাত্র ১৪০০ টাকা। আর মূখ্যমন্ত্রীর দরবারেই প্রতিদিন ভোরে ১৬ জন রোগী দেখতেন বিনে পয়সায়। যাদের সম্বল ছিলো না পথ্য কেনার, তাদের ওষুধ কেনার টাকা দিতেন। যাতায়াত ভাড়াও নিজের বেতনের টাকা থেকে দিয়ে দিতেন। নিজের সব জমি বিক্রি করলেন, শেয়ার বিক্রি করলেন, এমনকী সরকারের দেয়া শৈলশহর শিলং-এর প্রিয় বাড়িটাও তিনি জনসেবায় বিক্রি করে দিলেন।

একবার এক গুণগ্রাহী বলেছিলেন- সবকিছুই যে বিক্রি করে দিলেন। নিজের জন্য কিছু রাখলেন না? বললেন- সব মানুষের হৃদয়ের জায়গাটুকু যে আমার। আর কি চাই?

পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা নিয়ে যিনি কলকাতা শহরে এসেছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর মূখ্যমন্ত্রীর ঘরে পাওয়া যায় ১১ টাকা ২৫ পয়সা। কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত জীবনের সঞ্চয় ছিল মোট ছয়টাকা আর কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা। এই না হলে সত্যিকারের মানুষের হৃদয়ের জননেতা।

লেখক: আরিফ মাহমুদ, ছোটগল্পকার, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025