কামাল মেহেদী: আরো একটি বছর চলে গেল ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। বিদায়ী বছর ২০১৫ সালের পুরো সময়জুড়ে আইএস এবং ইউরোপের রিফিউজি সমস্যা ছিল ব্যাপকভাবে আলোচিত। তবে বিদায়ী বছরে ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যন্য দেশের মতো ইউকেতেও বিদায়ী বছরে ঘটে গেছে বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা।
বছরের শেষ দিকে উত্তর ইংল্যান্ডের বন্যা পরিস্থিতি সবাইকে নাড়া দিলেও মহিলা আর্চবিশপ নিয়োগ, পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং টিম পিকের মহাকাশভ্রমণসহ নানান স্মরণীয় ঘটনার কারণে বৃটিশ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০১৫ সালটি। এছাড়াও আইএস ইস্যু এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কেন্দ্রীক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণে মূলধারার পাশাপাশি বৃটিশ বাংলাদেশী কমিউনিটির কাছেও বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বিদায়ী বছর ২০১৫ সাল।
আইএস ইস্যুকে সঙ্গে নিয়েই মূলত যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৫ সালটি। জঙ্গী আর সন্ত্রাসে বিব্রত বিশ্ব মুসলিম কমিউনিটির জন্য ২৩শে জানুয়ারী ঘটে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন সৌদি আরবের বাদশা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ। কিং ফাহাদের মৃত্যুর পর ২০০৫ সালের ১লা আগষ্ট থেকে ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারী পর্যন্ত তিনি সৌদির বাদশাহ ছিলেন। বিশ্ব মুসলিম কমিউনিটির জন্য এবারের মিনা ট্রাজেডি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এবার হজ্জের সময় মিনায় পদদলিত হয়ে প্রাণ হারান প্রায় দেড় হাজারের বেশি হাজি। এর আগে ক্রান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান আরো ১শ ৭ জন। এর বাইরে ৭ জানুয়ারী ফ্রান্সের চার্লি আব্দো ম্যাগাজিন অফিসে হামলার ঘটনা এবং গ্রিসের নির্বাচন ছাড়া ইউরোপে আলোচিত বিশেষ কিছু ছিল না। বেইল আউটকে কেন্দ্র করে মধ্যবর্তী নির্বাচনে এলেক্সিক সাইপ্রাস গ্রিুসের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ফেব্রুয়ারীতে বিশ্বে তেমন আলোচিত কিছু না ঘটলেও মার্চের ২০ তারিখে সুর্যগ্রহণ বেশ আলোচিত ছিল। প্রায় ১৫ বছর পূর্ণ সুর্যগ্রহন দেখেন বিশ্বের মানুষ। অন্যদিকে ২৫শে এপ্রিলের নেপালের ভুমিকম্প কাঁদিয়েছে বিশ্বকে। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এ ভুমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আর আহত হন প্রায় ২৩ হাজার।
অন্যদিকে এপ্রিল থেকে শুরু হয় মাইগ্রান্ট বা রিফিউজিদের ইউরোপ যাত্রা। ১৩ এপ্রিল প্রায় ২৪১ জন মাইগ্রান্ট ইতালির সিসিলিতে এসে পৌছান। বিদায়ী বছরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া থেকে প্রায় ১ মিলিয়নের বেশি রিফিউজি স্থল ও জল পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে শিশু সমুদ্রতীরে শিশু আইলানের মর্মান্তিক মৃত্যু কিছুটা হলেও নাড়া বিশ্ব বিবেককে।
১লা জুন, চায়নার একটি জাহাজ ডুবির ঘটনাও নাড়ায় বিশ্বকে। ৪শ ৫৬ জন আরোহির মধ্যে জাহাজের ক্যাপ্টেনসহ মোট ১৪জনকে জীবিত এবং নিখোঁজদের মধ্য থেকেও মাত্র ২৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে ২৬শে জুন তিউনিসিয়া সমুদ্রতীরের সন্ত্রাসী হামলাটিও নাড়া দেয় বিশ্ববাসিকে। বিভিন্ন দেশের ৩৮ জন পর্যটক প্রাণ হারান ওই দিনের বন্দুকধারীর হামলায়।
এদিকে জুলাইয়ে সৌরচালিত একটি বিমান দিয়ে ননস্টপ ফ্লাইট করে জাপান থেকে হাওয়ালি পৌছান এক সুইস পাইলট। এদিকে চায়নার তানজানিয়ায় একটি বিস্ফোরণে প্রায় ১৪ জন নিহতের ঘটনা এবং ফ্রান্সে ট্রেইনে একটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাও কিছুদিন আলোচিত ছিল আগষ্টে।
ওদিকে সেপ্টেম্বরে সিরিয়ায় হামলা শুরু করে রাশিয়া। আর অক্টোবরে ইজিপ্টে রাশিয়ার একটি বিমান ভুপাতিত হয়। এতে ২২৪ জন যাত্রী নিহত হন। তাদের বেশিভাগই ছিলেন রাশান নাগরিক। নভেম্বরে মিয়ানমারে অং সান সুচির নির্বাচনে জয় লাভের ঘটনার বাইরে প্যারিস হামলা, তুরস্কে রাশিয়ান বিমান ভুপাতিতের ঘটনা এবং মালির হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা বেশ আলোচিত ছিল। ২০ নভেম্বর মালির হোটেলে হামলা এবং ২৫ নভেম্বর তুরস্ক সীমান্তে রাশিয়ার একটি যুদ্ধ বিমান ভুপাতিত করে তুরস্ক বাহিনী।
এর বাইরে নভেমম্বেরে সবচাইতে আলোচিত বিষয় ছিল ১৩ নভেম্বরের প্যারিস হামলা। একটি কনসার্ট এবং স্টেডিয়ামের বাইরে একই সঙ্গে দুটি হামলায় অন্তত ১শ ২৯ জন নিহত হন। এর ঘটনার পরপরেই সিরিয়ার আইএস ঘাটিতে বিমান হামলা শুরু করে ফ্রান্স। সিরিয়ার আইএস ইস্যুর মাঝে মার্কিন ধনকুবের ও আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন প্রত্যাশি ডুনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় বিশ্বে।
এর বাইরে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সৌদি পৌর নির্বাচনে মহিলাদের অংশ গ্রহণের ব্যাপারটিও ছিল বেশ আলোচিত। বছরের শেষ দিকে চায়নায় আরো একটি ভুমিধ্বসের ঘটনাও বেশ নাড়া দিয়েছে। এছাড়াও জুলাইয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিজ্ঞানী ডক্টর আব্দুল কালাম এবং নভেম্বরে জলবায়ূ সম্মেলন ছিল বেশ আলোচিত বিদায়ী বছরে।
ইউকে ও বাংলাদেশী কমিউনিটি:
এদিকে ইউকের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুগের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ২০১৫ সালটি। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মহিলা বিশপ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আর্চ বিশপ লিবি লেইন। এছাড়া বছরের প্রথম মাসটি কোনো মতে কেটে গেলেও ফেব্রুয়ারী মাসটি আলোচিত ছিল।
বেথনাল গ্রীন একাডেমীর ১৫ বছর বয়সের শামীমা বেগম, আমিরা আব্বাসী এবং ১৬ বছরের খাদিজা সুলতানা ইস্তাম্বুল হয়ে সিরিয়ার আইএস ঘাটিতে যোগ দেয়ার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এ ঘটনাটি ইউকের বাংলাদেশী কমিউনিটিকেও বেশ নাড়া দেয়। মার্চে তেমন আলোচিত কিছু না হলেও এপ্রিলের একটি ঘটনা ইউকের মূলধারা এবং বাঙালী কমিউনিটিতে বেশ আলোড়ন তুলে।
২৩শে এপ্রিল ইলেকশন কোর্টের রায়ে টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানকে দোষি সাব্যস্তের ঘটনা ইউকের বাংলাদেশী কমিউনিটির মানুষ এতো সহজে ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। ইউকে ও ইউরোপের বাঙালীদের কাছে একটি অহঙ্কারের নাম ছিল লুৎফুর রহমান। প্রবাসীদের অঙ্কারের জায়গা ছিল টাওয়ার হ্যামলেটস তথা ইউকের প্রথম মুসলিম ও বাঙালী নির্বাহী মেয়র পদটি।
এদিকে ইংলিশদের কাছে ২০১৫ সালের মে মাসটি বেশ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মাসের শুরুতেই প্রিন্স ইউলিয়াম এবং প্রিন্সেস কেইটের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্সেস চার্লটের জন্ম হয়। আর মে মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ৩৩১ সিট নিয়ে এককভাবে ক্ষমতায় আসে টোরি। আর প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরনের সাবেক পার্টনার নিক ক্ল্যাগের দল পায় মাত্র ৮টি সিট।
অন্যদিকে ৫৬টি সিট পেয়ে চমক দেখায় স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। ২৩২টি সিট নিয়ে বিরোধী দলেই থাকে লেবার। তবে নির্বাচনে ভরাডুবির ফলে লিডারশীপ পদ থেকে লেবার লিডার এড মিলিব্যান্ড এবং লিবডেম লিডার পদ থেকে নিক ক্ল্যাগ পদত্যাগ করেন। তবে এ নির্বাচনে সবচাইতে বেশি অর্জন হয়েছে বৃটিশ বাঙালীদের। এমপি রুশানারা আলীর সঙ্গে ডক্টর রূপা হক এবং টিউলিপ সিদ্দিকী, মোট ৩জন বৃটিশ বাঙালী এখন হাউস অব কমন্সে। বাঙালীদের এ আনন্দের মাঝেই জুন মাসে ১১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় টাওয়ার হ্যামলেটসের পরবতী মেয়র নির্বাচন।
দুই বার চেষ্টার পর তৃতীয়বার এসে টাওয়ার হ্যামলেটসের এক্সিকিউটিভ মেয়র নির্বাচিত হন লেবারপ্রার্থী জন বিগস। তবে তিউনিসিয়া আক্রান্তের কারণে বৃটিশদের জন্য সবচাইতে বেশি বেদনার ছিল এ মাসটি। তিউনিসিয়ায় বন্দুকধারীর হামলায় নিহতের মধ্যে ৩০জনই ছিলেন বৃটিশ পর্যটক। তিউনিসিয়া শোকের মাঝেই সবাইকে ছেড়ে চলে যান লিবডেমের সাবেক লিডার চার্লস কেনেডি।
এছাড়া আগষ্টে সাসেক্সে শোরহ্যামের এয়ারশোতে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান ১১ জন। সেপ্টেম্বরে আবার আলোচনায় আসে রাজনীতি। কট্টর বামপন্থী নেতা জেরেমি করবিন লেবার পার্টির লিডার নির্বাচিত হন এ মাসে। আর অক্টোবরে গোয়ান্তানামোবে থেকে বিণা বিচারে প্রায় ১৩ বছর আটক থাকার পর ইউকেতে ফিরে আসে শাকের ওমর। ডিসেম্বর মাসে সিরিয়ায় বিমান হামলা ইস্যুতে পার্লামেন্টে এমপিদের ভোটাভুটি এবং মার্কিন ও রাশান নাগরিকের সঙ্গে যৌথভাবে বৃটিশ নাগরিক টিম পিকের মহাকাশ ভ্রমনের কারণে বৃটিশ জনগণের কাছে বেশ স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০১৫ সালটি।
এছাড়াও ডুনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিম বিরোধী ঘোষণা এবং মুসলিম বিদ্বেষী বিভিন্ন ঘটনাও ইউকে আলোচিত ছিল বিদায়ী বছরে। বিদায়ী বছরে লন্ডনে নাইফ ক্রাইমও ছিল বেশ আলোচনায়। লন্ডনে নাইফ ক্রাইমে ১২ মাসে ১৪ জন প্রাণ হারান। ২০১৫ সালের শেষ দিনটিতে এসে মুসলিম কমিউনিটির জন্য রেডিংয়ের মোহাম্মদ রাহমান এবং স্ত্রী সানা খানের বিচার এবং দন্ডটি বেশ আলোচিত।
নিজের ঘরে বোমা বানিয়ে লন্ডনে সেভেন সেভেন বোম্বিংয়ে দশম বার্ষিকীতে হামলা পরিকল্পনা ছিল বলে তাদের উপর অভিযোগ আনা হয়। আর সেই সঙ্গে ছিল উত্তর ইংল্যান্ডের বন্যাকে সঙ্গে নিয়েই ইউকেবাসী পদার্পন করছে নতুন বছর ২০১৬ সালে। নতুন বছরটি আরো শুভময় হোক সবার জন্য।