তাইছির মাহমুদ: ফারসানা তাহমিন লিপি। সিলেট শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। নভেম্বর মাসে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে লন্ডন আসতে চেয়েছিলেন। যাবতীয় কাগজপত্রসহ ভিসার জন্য আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁর লন্ডন আসা হয়নি। করণ আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে।
ভিসা হয়নি এতে দুঃখ নেই তাঁর। কষ্টটা অন্য জায়গায়। এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসার তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ফারসানা তাহমিন আদৌ কোনো চাকরি করেন বলে তিনি বিশ্বাসই করেন না। অর্থাৎ তাঁর কাছে সবকিছুই ভূয়া প্রতীয়মান হয়েছে। এজন্য ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখানে আত্মসম্মানবোধের বিষয়টি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাইকমিশন ভিসা না দেওয়ার এখতিয়ার রাখে।
কিন্ত একজন প্রকৃত চাকরিজীবীকে ভূয়া সার্টিফাই করাটা কি অসম্মানের নয়। ফারসানা তাহমিন এ নিয়ে আইনী লড়াই করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় আইনী সহায়তার অভাবে সেটা আর এগোয়নি। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের একাউন্ট হোলডার হওয়ার সুবাদে তাঁর সাথে পরিচয়। তাই বিষয়টি ক্ষোভের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন।
শুধু ফারসানা তাহমিনই নন, প্রতিদিন এমন অনেকের আবেদন প্রত্যাখান হচ্ছে- যারা ইতোপূর্বে একাধিকবার যুক্তরাজ্য সফর করে ভিসার নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে দেশে ফিরে গেছেন। অথচ তাদের বলা হচ্ছে, লন্ডন এলে ফিরে যাবে না বলে সন্দেহ হচ্ছে। আর এজন্য তাঁদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকেরই ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার খবর পাওয়া যায়। কেউ কেউ জরুরী ব্যবসায়িক কাজে লন্ডন আসতে চান। ইতোপূর্বে লন্ডন সফর করে ফিরে গেছেন, তাঁরাও ভিসা পাচ্ছেন না। এতে করে তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কোনো সংগঠন লন্ডনে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। বাংলাদেশের কোনো বিশিষ্টজনকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু অবেদনের পর ভিসা হচ্ছে না। তাই কাংকিত সফর বাতিল করতে হচ্ছে। বাতিল করতে হচ্ছে প্রস্তবিত অনুষ্ঠান।
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ আবেদনপত্র জমা করার পর এমন কিছু খোঁড়া যুক্তি দিয়ে প্রত্যাখান করা হচ্ছে, তা শুধু হাস্যকরই নয়; কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানহানিকরও বটে। সম্প্রতি এক ব্যবসায়ীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে ভিসা অফিসার মন্তব্য করেছেন, “আজকাল বাংলাদেশে সবধরনের ডকুমেন্ট কিনতে পাওয়া যায়।”
এই হলো বৃটেনের বর্তমান ইমিগ্রেশনের হাল। ভিসা আবেদন ক্ষেত্রে মোটা অংকের ফি নেয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভিসা দেয়া হচ্ছে না একদমই। এতে করে বৃটিশ সরকার লাভবান হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ। একসময় ৭০ শতাংশ ভিসা আবেদন সফল হতো। কিন্তু এখন ১০ শতাংশ আবেদনকারীই ভিসা পাচ্ছেন না। সুতরাং, এটা সহজেই অনুমেয়-ভিসা প্রাপ্তির হার ৭০ শতাংশ থেকে অন্তত ৩০ শতাংশে নেমে এলে তা মেনে নেওয়া যেতো।
কিন্তু ৭০ থেকে যখন ধপাশ করে ৫ শতাংশে নেমে আসে তখন আর কী বলা হয়। বৃটেন থেকে স্পনসর যোগাড় করা, ভিসার আবেদন তৈরি, সর্বোপরি মোটা অংকের ফি জমা দেওয়ার পর যখন ভিসা না দিয়ে প্রত্যাখান করা হয় তখন বিষয়টি খুব পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।
এক সময় এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেও লন্ডনে ইমিগ্রেশন ট্রাইব্যুনালে অ্যাপিল করা যেতো। এতে দেখা গেছে অধিকাংশ অ্যাপিলই ট্রাইব্যুনালে গিয়ে সফল হতো। অনেক সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারক এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসারের ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এসব ওয়েস্টিং অব টাইম। এভাবে আবেদন প্রত্যাখ্যান করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
বিন্তু বৃটিশ সরকার এখন সেই পথও বন্ধ করে দিয়েছে। আইন করে ভিজিটর ও স্টুডেন্ট ভিসার আবেদনের অ্যাপিল-রাইট খর্ব করা হয়েছে। ফলে এট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসার ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও কিছু করার নেই।
অনেকে মনে করেন ভিসা অফিস দিল্লিতে স্থানান্তরই এই সমস্যার মূল কারণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাই মূল কারণ নয়। ইমিগ্রেশন মিনিস্টার জেমস ব্রোকেনশায়ারের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যে মনে হয়েছে নন-ইউরোপিয়ান দেশগুলো থেকে ইমিগ্রান্ট আসুক-সেটা বৃটিশ সরকার চায়না। সরকার বরং তাদের প্রবেশ রুখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
গত ৯ নভেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের ১০ ডাউনিং স্ট্রিট অফিসে এক মিডিয়া রিসেপশনে আমন্ত্রিত ছিলাম। সেখানে বৃটিশ সাংবাদিকরা ছাড়াও সরকারের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী এমপিরাও ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে ইউকে ভিসা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম স্বয়ং ডেভিড ক্যামেরনের সাথে। কিন্তু সেই সুযোগটা হয়নি।
তবে এ নিয়ে কথা হয় ইমিগ্রেশন মিনিস্টার জেমস ব্রোকেনশায়ারের সাথে। কুশল বিনিময় শেষে কৌশলে তাঁকে প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছিলাম। প্রথমত দিল্লিতে ভিসা অফিস স্থানান্তরের ফলে ভিসা প্রাপ্তির হার ১০শতাংশে নেমে আসার একটি বর্ণনা দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তার ভিসা প্রত্যাখ্যানের বিষয়টিও তুলে ধরলাম। বললাম, এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করতেই পারেন, কিন্তু একজন প্রকৃত চাকরিজীবীকে এভাবে ভূয়া বলে মন্তব্য করাটা অপমানজনক।
তাছাড়া, সিলেট ভিসা অফিস থেকে ওই ব্যাংকের দুরত্ব মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা। দিল্লির ওই এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসার চাইলে সিলেট অফিসে একটি ফোন করে খোঁজ নিতে পারতেন ওই আবেদনকারীর চাকরি আছে কি-না? গোজামিলের জবাবে মন্ত্রী বললেন, এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসারের হাতে এই সময় নেই যে তাঁরা ফোন করে দেখবে আবেদন সত্য কি-না। তারা কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করেই ভিসা ইস্যু করে থাকে।
তাঁর কাছে আরো প্রশ্ন ছিলো- ভিসা অফিসটি কি দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে। জবাবে জেমস ব্রোকেনশায়ার সরাসরি বললেন, না প্রশ্নই আসে না। বরং আমরা অন্যান্য দেশের ভিসা অফিসগুলো একটি অফিসের অধীনে একীভূত করতে চাচ্ছি। ইমিগ্রেশন নিয়ে আরো কিছু কথা হয়েছিলো তাঁর সাথে।
তিনি বলেছিলেন, সামনের দিনগুলোতে ধরপাকড় আরো জোরদার করা হবে। কারণ কনজার্ভেটিভ পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা ব্রিটেনে অবৈধ ইমিগ্রান্টের সংখ্যা কমিয়ে এক লাখে নিয়ে আসতে চায়। সাড়ে ৬ কোটি জনসংখ্যার ব্রিটেনে অবৈধ ইমিগ্রান্টের সংখ্যা কত তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে অনুমান করা হয় ১১ লাখের মতো হবে। এই ১১ লাখের মধ্যে ১০ লাখকে বৃটেন থেকে বিতাড়িত করতে চায় সরকার। এটাই তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। আর তাই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ইমিগ্রান্ট তাড়াতে সরকার মরিয়া হয়ে ওঠেছে।
বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের এমন সব জায়গায় বর্তমানে অপারেশন চালানো হচ্ছে বিগত এক যুগ সময়ে কখনো এমনটি দেখিনি। আর এমন কিছু নতুন আইন করা হচ্ছে যা ইমিগ্রান্টের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘাঁর মতোই। কিছুদিন পরপর হোম সেক্রেটারি থেরেসা মে নতুন নতুন আইন করছেন।
অবৈধ ইমিগ্রান্টকে কাজ দিলে ২০ হাজার পাউন্ড জরিমানার বিধান তো আছেই; উপরন্তু সম্প্রতি সংযোজন করা হয়েছে বাসা ভাড়া না দেওয়ার আইন। কোনো এস্টেট এজেন্ট অবৈধ ইমিগ্রান্টকে ঘর ভাড়া দিলে তাকে মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হবে।
এসব বিবেচনায় ভিসা অফিস ঢাকা থেকে দিল্লীতে সরিয়ে নেয়া এবং ভিসা প্রদান অনেকটা বন্ধ করে দেয়ার পেছনে সরকারের কঠোর ইমিগ্রেশননীতিই কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের পলিসি ইমিগ্রেশনবান্ধব নয়, বরং ইমিগ্রেশন বিরোধী। সুতরাং কনজার্ভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে ইমিগ্রেশন পলিসি সহজ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই বললেই চলে।
দিল্লি থেকে ভিসা অফিস ফিরিয়ে আনার দাবীতে লন্ডনে বিভিন্নভাবে আন্দোলন চলছে। যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহৎ কমিউনিটি সংগঠন গ্রেটার সিলেট কাউন্সিল ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সম্প্রতি চালু হয়েছে অনলাইন পিটিশন ক্যাম্পেইন। এক লাখ স্বাক্ষর সংগৃহিত হলে বৃটিশ পার্লামেন্টে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিতর্ক আয়োজনের সুযোগ রয়েছে।
তবে ইপিটিশনে স্বাক্ষরের সময়সীমা আর মাত্র ক’দিন বাকী আছে, অথচ সর্বসাকুল্যে সাক্ষর সংগৃহিত হয়েছে ১০ হাজারের কিছু বেশি। তাই আশাব্যঞ্জক কিছু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাছাড়া ১ লাখ স্বাক্ষর সংগৃহিত হলেই যে পার্লামেন্টে এ নিয়ে আলোচনা হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ যারা আলোচনা করবেন তাদের এ ব্যাপারে নেতিবাচক মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং আন্দোলন সংগ্রাম করে কী লাভ হবে আপাতত বলা যাচ্ছে না।
বৃটেনে বৈধভাবে ৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশী বসবাস করেন। বাংলাদেশের সাথে এই প্রবাসীদের রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক। বৃটেন থেকে প্রবাসীরা নিজের স্বজনদের দেখতে যেমন বাংলাদেশ যাবেন;তেমনী বাংলাদেশ থেকেও স্বজনরা ব্রিটেনে তাঁদের আত্মীয় স্বজনকে দেখতে আসবেন-এটা একটি সামাজিক ও মানবিক বিষয়।
ভিসা অফিস ঢাকা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের ফলে ভিসা ইস্যু একেবারে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে স্বজনেরা ব্রিটেন আসতে পারছে না। তাদের আত“ীয় স্বজনকে দেখতে পারছেন না। প্রবাসীরাও নিজেদের ব্যবসা, চাকরি, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াজনিত কারণে দেশে যেতে পারছেন না। এতে করে দু’দেশের স্বজনদের মধ্যকার পরিবারিক ও আত“ীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এটা ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আইনের লংঘনও বটে।
তাই বৃটেনে ইমিগ্রেশন নিয়ে কাজ করছে- এমন কোনো প্রতিষ্ঠান বৃটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আইনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারে। আদালত বিষয়টি বিবেচনা করে হয়তো ভিসা অফিস ফিরিয়ে আনার পক্ষে রায় দিয়ে দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ভিজিটর ও স্টুডেন্ট ভিসায় অ্যাপিল-রাইট ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে উত্থাপন করা উচিত। কারণ এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্সের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে একজন প্রকৃত আবেদনকারী ভিসা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অ্যাপিল রাইট থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে অলডগেইট থেকে মাইল এন্ড পর্যন্ত অর্ধ কিলোমিটার রাস্তায় অর্ধশতাধিক বাঙালি সলিসিটর ও ব্যারিস্টার ইমিগ্রেশন প্রাক্টিস করে থাকেন। তাঁদের মধ্য থেকে চৌকস আইনজীবীদের একটি টিম আইনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারেন। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় এ ধরনের লড়াইয়ে আইনজীবীদের বিজয়ী হতে দেখা গেছে। এটা একটি মানবিক বিষয়। তাছাড়া এই অচলাবস্থা এখানকার বাঙালি ইমিগ্রেশন প্রাক্টিসেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউকে ভিসা প্রপ্তির হার হ্রাস পাওয়ায় বাঙালি আইনজীবীদের ইমিগ্রেশন প্রাক্টিসও প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন। taysir.taysirmahmud@gmail.com