শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ০৫:২১

পানামা পেপারস: পুতিন কেন এক নম্বরে?

পানামা পেপারস: পুতিন কেন এক নম্বরে?

মশিউল আলম রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনপানামা পেপারস কেলেঙ্কারি যেদিন ফাঁস হলো, সেদিন সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পেল, দুর্নীতিবাজ, কর ফাঁকিবাজ ও টাকা পাচারকারীদের শিরোমণি হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘গার্ডিয়ান’সহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় সব দুর্নীতিবাজের ওপরে ছাপা হলো পুতিনের ছবি।

কিন্তু মজার ব্যাপার, পুতিন বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের কোনো অফশোর কোম্পানির মালিকানা বা অংশীদারি নেই। তাঁরা টাকা পাচার করেছেন, কর ফাঁকি দিয়েছেন—এ রকম কোনো তথ্য পানামা পেপারসের ১১ মিলিয়ন নথির কোথাও নেই।

তাহলে কেন পুতিনের ছবি ও নাম ছাপা হলো দুর্নীতিবাজদের তালিকার একদম শীর্ষে?

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কেউ কেউ এই প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু এর কোনো সঠিক জবাব মেলেনি। আংশিক জবাব হচ্ছে, কর ফাঁকিবাজদের মধ্যে তিনজন রুশ ধনকুবের আছেন, যাঁরা পুতিনের বন্ধু। পানামা পেপারসের নথিগুলোয় তাঁদের ‘বন্ধুত্ব’ সম্পর্কে কিছু লেখা আছে কি না, তা এখনো জানা যায়নি। কারণ, যেসব সংবাদমাধ্যম পানামা পেপারসের নথিগুলোর ভিত্তিতে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করছে, তারা সংশ্লিষ্ট নথিগুলো প্রকাশ করেনি।

কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) নামে সাংবাদিকদের যে প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্রগুলোকে পানামা পেপারসের নথিগুলো সরবরাহ করেছে, তারাও ইন্টারনেটে কোনো ডেটাবেইস প্রকাশ করেনি। তারা বলছে, পানামা পেপারস এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ফাঁস করা গোপনীয় তথ্যভান্ডার: ২.৬ টেরাবাইট জায়গা লেগেছে এসব নথি সংরক্ষণের জন্য। উইকিলিকসের ফাঁস করা আমেরিকান কূটনৈতিক তারবার্তা যেটা ‘কেব্লগেট’ নামে পরিচিত, তাতে নথির সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের কিছু বেশি। কিন্তু পানামা পেপারসে ১ কোটি ১০ লাখের বেশি নথি আছে বলে দাবি করছে আইসিআইজে। এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা আমেরিকান ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) গোপনীয় নথিপত্রের সংখ্যাও এত বিপুল ছিল না। আইসিআইজের দাবি সত্য হলে পানামা পেপারসই এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ফাঁস করা গোপনীয় তথ্যভান্ডার। কিন্তু এই তথ্যভান্ডার তারা সর্বসাধারণের পাওয়ার উপায় রাখেনি।

আর এসব নথির ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো যে সাংবাদিকতা শুরু করেছে, তার সততা নিয়ে কিছু সংশয় ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, পানামা পেপারসে আমেরিকান কোনো ব্যক্তির নাম নেই কেন? ওই দেশের একজন ধনকুবেরও কি কর ফাঁকি দেন না? একজনেরও কি অফশোর কোম্পানি নেই? ডিক চেনি বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সবকিছুই কি শতভাগ স্বচ্ছ?

পানামা পেপারসে শীর্ষ দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনেতাদের তালিকায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোর নাম আছে, অথচ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সেটার প্রচার নেই। হইচই করা হচ্ছে না সৌদি আরবের বাদশার কর ফাঁকি ও টাকা পাচার নিয়ে। আর অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়ার যেসব অভয়ারণ্য বা ট্যাক হেভেন রয়েছে, সেগুলোর সবই পশ্চিমা দুনিয়ায়, রাশিয়ার আশপাশে নয়।

পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার রাজনৈতিক বিরোধের বর্তমান বাস্তবতায় পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো যদি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাবমূর্তি কলুষিত করার অভিযানে নেমে থাকে, তাহলে সেটা তাদের সাংবাদিকতার জন্যই ক্ষতিকর হবে। পানামা পেপারসের গোপন নথিগুলো আইসিআইজেকে কে বা কারা দিয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানটি প্রকাশ করেনি, নিশ্চিতভাবেই কখনো তা প্রকাশ করবে না। কিন্তু অনুমান করা যায়, তারা এই তথ্যভান্ডার পেয়েছে ‘হ্যাকার’দের কাছ থেকে। অথবা পানামাভিত্তিক আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার কোনো সংক্ষুব্ধ কর্মীও (হুইসলব্লোয়ার) সেটা করে থাকতে পারে। তবে কাজটা যে-ই করুক না কেন, তার উদ্দেশ্য যে মহৎ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এখন আইসিআইজে ও তার সহযোগী সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সেসব নথির ব্যবহার সৎভাবে না করে, যদি বন্ধুদের বাঁচিয়ে শুধু শত্রুদের বিরুদ্ধেই সেগুলো ব্যবহার করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাংবাদিকতার সংস্কৃতি। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ আর আদর্শবাদী নাম না-জানা ‘হ্যাকার’দের বদৌলতে গোপনীয়তার বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার যে সুযোগ সংবাদমাধ্যমের সামনে এসেছে, যেটার সূচনা করেছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও এডওয়ার্ড স্নোডেন, সাংবাদিকতার সেই ধারা পানামা পেপারসের মাধ্যমে আরও এগিয়ে যাবে, নাকি কালিমালিপ্ত হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025