এ কে এম জাকারিয়া: তনু নামের মেয়েটির কথা মনে আছে তো? ওই যে গত ২০ মার্চ রাতে যাঁর লাশ পাওয়া গেল কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায়। নাটক করতেন যে মেয়েটি। তাঁর হত্যার বিচার চেয়ে হইচই হলো বেশ কিছুদিন।
শুরুতে ফেসবুকে, তারপর রাস্তায়। লংমার্চ হলো। দেশের নানা জায়গায় সরব হলেন ছাত্রছাত্রীরা। ঘটনার পর এক মাসেরও বেশি সময় পার হলো। কিছু ফল কি মিলল? এখন ‘তনু’ ফেসবুকেও নেই, রাস্তায়ও নেই। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে আজ সোমবার যে হরতাল ডাকা হয়েছিল, তা গতকাল রোববার আমাদের কতজনের মনে পড়েছিল?
মনে থাকবেই-বা কেন! আমাদের মনে যে ভর করেছে হতাশা। আমরা ভাবতে শুরু করেছি, এসবের কোনো বিচার-আচার হয় না, হবে না। কত খুনের ঘটনাই তো ঘটে গেল গত কয়েক বছরে। বিচার তো দূরে থাক, কারা খুন করল, কেন করল—এসব আমরা জানতেই পারলাম না! আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, আমরা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছি। তনুকে আমাদের মনে থাকবে কেন!
তনুর লাশের দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয়েছে ৩০ মার্চ। এখনো ফল মেলেনি। ময়নাতদন্তের ফল পেতে সাধারণভাবে এত সময় লাগে না। তনুর ক্ষেত্রে কাজটি এতটাই কঠিন হয়ে গেল! নাকি কঠিন করা হয়েছে? এখন বলা হচ্ছে, তনু ধর্ষণের শিকার হননি। তা যদি না-ও হয়, মেয়েটি খুনের শিকার তো হয়েছেন! নাকি তাও হননি? ১ এপ্রিল থেকে এই মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।
প্রথম আলোর কুমিল্লা প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করে তথ্য পেলাম, এ পর্যন্ত ৫৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তারা। এখানেও কোনো ফলাফল নেই। আমরা দেখেছি, অনেক খুনের ঘটনা এভাবেই একসময় চাপা পড়ে যায়। তনুরটাও সেদিকে যাচ্ছে—এমন বিশ্বাস যদি আমাদের মধ্যে গেড়ে বসে, তবে সেটা কি খুব দোষের! আমরা তনুকে ভুলে যাচ্ছি, কারণ তনুকে ভুলে যাওয়াটাকেই আমরা সম্ভবত নিজেদের জন্য স্বস্তির মনে করছি।
আর তনুকে ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রও এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। ঘটে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক খুনের ঘটনা। তনুর ক্ষেত্রে দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের কিছু ঘটনা ঘটেছে। রেজাউল করিম সিদ্দিকীর মতো একজন নির্বিবাদী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে হত্যার পর তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও তেমন প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা গেল না। তনুর ঘটনা ও এ নিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, তা সম্ভবত আমাদের আরও ভোঁতা করে দিয়েছে, দিচ্ছে। আমরা বুঝে গেছি, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এসবে কোনো কাজ হয় না।
আমরা তনুকে ভুলে যাওয়ার পথে আছি। আমরা রেজাউল করিমকে ভুলে যাব। কারণ, আমরা জানি, সামনে এমন আরও নাম আসতেই থাকবে। এই তালিকা বাড়তেই থাকবে। আমরা কত নাম মনে রাখব?