মাজেদুল নয়ন: এবারের আষাঢ়ের বৃষ্টি বেশ ভালোই ভিজিয়েছে মানুষকে। কিন্তু বর্ষার বৃষ্টি সিটি করপোরেশনগুলোতে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে, সেই জলেই নৌকা ডুবলো ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের। নৌকাডুবির বড় ফ্যাক্টর রয়েছে অনেক। প্রায় সব সিটি করপোরেশনেই জাতীয়ভাবে সরকারি-দল-বিরোধী মনোভাব কাজ করেছে ভোটারদের মধ্যে।
অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ খুঁজতে। তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট ফ্যাক্টরকে দায়ী করা যায় না। দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, শ্বশুরবাড়ির ভোট, হেফাজতের ভোট, পোশাকশ্রমিকদের ভোট নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। তবে ফ্যাক্টর হিসেবে এবার প্রকৃতিও কিন্তু বিরুদ্ধাচরণ করেছে। মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল ক্ষমতাসীনদের নৌকা ডোবাতে।
আষাঢ়ের দুঃখগাথা ২০১০ সালের আষাঢ় মাসের ৩ তারিখের কথা মনে হয়েছে এবার বারবার। সেদিন হাঁটু ও কোমর পানি ঠেলে ভোট দিতে গিয়ে ব্যালটে ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন ভোটাররা। বিপুল ভোটের ব্যবধানে নৌকাসহ ডুবে গিয়েছিলেন এক সময়ের দাপুটে মেয়র চট্টগ্রামের লৌহমানব খ্যাত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারই এক সময়ের সহযোগী মনজুর আলম। ওই নির্বাচনে হট ফেভারিট মহিউদ্দিন চৌধুরী পান তিন লাখ ৮৩ হাজার ৬১৭ ভোট। আর মেয়র মনজুর আলম পান চার লাখ ৭৯ হাজার ১৪৫ ভোট। মহিউদ্দিন চৌধুরীর চেয়ে মনজুর আলম ৯৫ হাজার ভোট বেশি পাবেন এটা কারো কল্পনাতেই ছিল না।
জলে ভেসেছিলেন কামরান সিসিক নির্বাচনের পূর্বে সিলেটে বাংলানিউজের স্টাফ করোসপন্ডেন্ট সাব্বির আহমেদের প্রতিবেদনে পড়েছিলাম, নগরীতে জলাবদ্ধতার কথা। জ্যৈষ্ঠের ২৭ তারিখে নিজে গিয়েছিলাম পূণ্যভূমিতে।
সিলেটের প্রাক্তন নগরপিতা কামরান নগরীর উন্নয়নে এতো বেশি উদাস ছিলেন যে সামান্য বৃষ্টিতেই শহর হয়ে যায় খাল। সেই খালে এবার মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার তরী ভাসাল কামরানকেই মাঝি বানিয়ে। বিবেচনা কিন্তু ভুল নয় একেবারে, কারণ নগরীর এই ১৮ বছরের পুরনো পাঞ্জেরি যে সিলেটকে আধ্যাত্মিক নগরীতে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
কিন্তু নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস! জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ, পদ্মাতেও পানি আসতে শুরু করেছিল। বৃষ্টি এসেছে মুষলধারে আর ভেসে উঠেছিল সিলেট শহর। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন নগরবাসী, দাতেঁ দাতঁ খিচে ভোট দিয়ে এসেছিলেন কামরানের বিরুদ্ধে। সিলেটে আষাঢ়ের পানিতে নৌকা ডুবে যায় ক্ষমতাসীন দলের।
জ্যৈষ্ঠের শেষ দিক থেকেই বৃষ্টি বাড়ছিল। সেই সময়টাই ছিল নির্বাচনী প্রচারণার সময়। ভোটারদের উন্নয়নের জলে ভাসানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন কামরান, তবে বাস্তবে বৃষ্টির জমে যাওয়া জলে ভাসছিল সিলেটবাসী।
কামরানের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আরিফুল হকের জন্যে নির্বাচনী প্রচারণা সহজতর করে দিয়েছিল আষাঢ় মাস। নির্বাচনের মাত্র একদিন আগেও মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল সিলেটে। সেদিন বৃষ্টির ফোঁটা কামানের গোলা হয়ে কামরানের বুকে বিঁধলেও, শান্তির ঘুম তলিয়েছিলেন আরিফ।
বৃষ্টির জলে সেদিন ভেসে যাচ্ছিল সিলেটের প্রধান সড়কগুলো। ডুবেছিল রাস্তাঘাট। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটের পাশাপাশি ডুবেছেন কামরানও। ভোটারের মনে বারবার জাগিয়ে দিয়েছে জলাবদ্ধাতার ক্ষোভ।
সে সময় নগরবাসী বাংলানিউজকে বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা এবারের সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কামরানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। আষাঢ়ের বৃষ্টি সেটি প্রমাণ করে দিয়েছিল। নৌকা ভর্তি আনারস প্রতীক ডুবে যায় বিপুল ব্যবধানে।
টেলিভিশন প্রতীকে ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী এক লাখ সাত হাজার ৩৩০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। আর ১৮ বছর ধরে সিলেট শহরের ভালো-মন্দের কাণ্ডারি কামরান পান ৭২ হাজার একশত ৭৩ ভোট।
নির্বাচন আষাঢ় মাসে না হয়ে বরং অন্য কোনো মাসে হলে নৌকা যে তীরে পৌঁছাতো এমনটি বলা যায় না। তবে বৃষ্টি না হলে, রাস্তায় জলাবদ্ধতা হতো না। জনগণের চোখ থেকে কিছুটা হলেও আড়াল থাকতো কামরান আর অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মহিতের উদাসীনতার কথা। হারের ব্যবধান আরো কিছুটা হলেও হয়তো কম হতো।
বরিশালেও ছিল জলের অভিশাপ বরিশাল নির্বাচনেও ছিল আষাঢ়ের অভিশাপ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। আষাঢ়ের অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর বেশিরভাগ এলাকা কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। নৌকা ভেসে থাকতে পারেনি।
জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময় থেকেই তুমুল বর্ষণ হচ্ছিল বরিশালেও। নগরীর সদর রোড, বগুড়া রোড, ফকিরবাড়ি রোড, কালীবাড়ি মোড়, হাসপাতাল রোডসহ কয়েকটি রোডে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নগরীর পুকুর ও খালগুলোর পানি উপচে পড়ে। বঙ্গবন্ধু উদ্যানসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠগুলোতে পানি কল কল করেছিল।
বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সেরাজুল ইসলামের সিরাজের ২৪ মের প্রতিবেদনে জানতে পেরেছিলাম, অতিবর্ষণের কারণে নগরীর বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের পথ-ঘাট ডুবে গিয়েছিল। চলাচল করতে রাস্তায় নৌকা ভাসিয়েছিল জনগণ, আর ডুবিয়ে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নৌকা। হিরনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল জলাবদ্ধতা ইস্যুকেই কাজে লাগিয়েছিলেন।
বরিশালে ব্যবধান বেশি হয়নি। ৮৩ হাজার ৭৫১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন কামাল। টেলিভিশন দেখে হিরন উঠিয়েছিলেন ৬৬ হাজার ৭৪১ ভোট।
কে জানে! এই আষাঢ়ে নির্বাচন না হলে হয়তো ১৭ হাজার ১০ ভোটের ব্যবধান উল্টিয়ে ফেলাও সম্ভব হতো হিরণের জন্যে।
এসেছিল বৃষ্টি, হেসেছিলেন মান্নান আষাঢ়ের শেষ দিকে নৌকা ডুবলো ঢাকার পাশে গাজীপুরে। এবার নৌকা বাইচে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাল্লা ছিলেন ক্লিন ইমেজের আজমত উল্লা খান। দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর শাসন করে আসছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ। এখানকার সব আসনই ক্ষমতাসীনদের দখলে।
কিন্তু আষাঢ় মাস এলেই গাজীপুর-টঙ্গী নগরীর আওয়ামী উন্নয়ন পরিণত হয় বাড়ির সামনের মজা পুকুরে। নর্দমার পানিতে নৌকা ভাসিয়ে বেশ চেষ্টাই চালিয়েছিল সরকারি দল। প্রধানমন্ত্রী নিজেও নৌকায় ফসল তুলতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাঙ্গল ধার চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই পাড়ে পৌঁছাতে পারলো না নৌকা। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে হেসেছেন মান্নান।
আষাঢ়ের ১২ তারিখে, সহকর্মী ইসমাইল হোসেনসহ গিয়েছিলাম শিল্পনগরী খ্যাত গাজীপুরে। পোশাকশিল্পের জন্যে উর্বর গাজীপুর-টঙ্গী নগরের গড়ে উঠায় শিল্পের ছোঁয়া দিতে পারেনি আওয়ামী শাসকেরা। সেদিনের টুপটুপ বৃষ্টিতেই টঙ্গী-গাজীপুরের ওপর দিয়ে যাওয়া মহাসড়কটিতে গাড়ির চালকদের জন্যে পুলসেরাত হয়ে উঠেছিল। অন্তত নিজের দুই চাক্কার পেট্রোল চালিত যানটি চালাতে গিয়ে সেটিই মনে হচ্ছিল।
আর শহরের গলিগুলোয় বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল নর্দমার জল। রাস্তার ওপর পানি জমে সড়কের ‘পেভমেন্ট সার্ফেস’ ভেঙে গিয়েছিল। জলাবদ্ধতায় ভাসছিল কলকারখানার মোবিল আর মানুষের বর্জ্য। আর এই জমে থাকা জলের নিচে ঘুপটি মেরে থাকা ম্যানহোলে যেসব রিকশার চাকা পড়েছিল, সেই চালক বা যাত্রী বাংলায় অকথ্য ভাষায় ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন নৌকার মাঝি আজমত আর তার পেছনের ক্ষমতাসীন দলকে! সেই নোংরা পানিতে ডুব দেওয়া জনগণের ব্যালট মনে হয় না পড়েছিল আওয়ামী লীগের বাক্সে। লক্ষ ভোটের ব্যবধানে ডুবেছে দোয়াত-কালি মার্কাকে চইয়ে রাখা নৌকা মার্কা।
এবারে মধ্য আষাঢ়ের বৃষ্টি ছিল ধারাবাহিক। জলাবদ্ধতা আর কাদাপানির শহর টঙ্গীতে এ আষাঢ়ের নির্বাচনে যত বৃষ্টি হয়েছে ততই হেসেছিলেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম এ মান্নান। হাসতে হাসতে ঘরে নিয়ে গেছেন তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট। ফল দেখে মনে হয় মান্নানের পেছন পেছন ঘুরে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট পকেটে ঢুকিয়ে রাত সাড়ে আটটায় ঘরে ঢুকে গেছেন আজমত উল্লা।
ভোটের আগেই স্থানীয়রা জানিয়েছিলেন, গাজীপুরের জলাবদ্ধতা, সড়কের বেহালদশা এবং যানজট নিয়ে বিরক্ত তারা। যার প্রভাব পড়বে ভোটারদের ব্যালটে।
আষাঢ়ের যে সময়টায় আজমত ও আওয়ামী নেতারা ভোট চাইতে গাজীপুর চষে বেড়াচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গাজীপুর অংশের বেশির ভাগ যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী ছিল। বৃষ্টির পানি জমে সড়কে সৃষ্টি হয়েছিল বড় বড় খানাখন্দ। এ রকম খানাখন্দেই হয়তো নৌকার তলিতে বড় ফুঁটো তৈরি হয়েছিল। যার পানিতে উবে ডুবে গিয়েছিল নৌকা।
আওয়ামী লীগের দুই এমপির এলাকায় এমন অনুন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দায় নিতে হয়েছে মহাজোটের প্রার্থী আজমত উল্লাকেও। উঠে এসেছে গত সাড়ে চার বছরে এলাকার উন্নয়নের হিসাব-নিকাশ।
নির্বাচনের আগে আষাঢ়ের এই উপহাস-বৃষ্টি না হলে লাখের ব্যবধান হয়তো কমাতেও পারতেন পরিষ্কার পাঞ্জাবি, পায়জামা পরা ক্লিন ইমেজের আজমত।
Leave a Reply