শীর্ষবিন্দু নিউজ: ১৪ দিন বিরতির পর রোববার অধিবেশনের শুরুতেই তাদের এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্য সংসদে উত্তাপ ছড়ায়। ক্ষমতাসীন দলের সাংসদরা নারীদের নিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানালেও তার পক্ষেই কথা বলেছেন বিরোধী দলের সাংসদরা।
সম্প্রতি হাটহাজারীতে আহমদ শফীর ওই ওয়াজের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে এর তীব্র সমালোচনা উঠে। শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ওই বক্তব্যকে জঘন্য ও কুরুচিপূর্ণ’ উল্লেখ করে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শফীর বক্তব্যকে ‘কদর্য ও অশ্লীল’ আখ্যায়িত করে তার বিচার দাবি করেছেন সরকারি দলের কয়েকজন নারী সদস্য। অন্যদিকে বিরোধী দলের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এক সাংসদ শফীর বক্তব্য নিয়ে ‘মিডিয়া ক্যু’র অভিযোগ তুলে এর মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কথা বলেছেন।
পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে শুরুতেই আওয়ামী লীগের এ এন মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ বলেন, আহমদ শফী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ, অমানবিক এবং ঘৃণ্য। নারীর ক্ষমতায়নের ওপর এটি হস্তক্ষেপ বলে আমি মনে করি। নারীকে তিনি ঘৃণ্য ও পশু মনে করেন। তাহলে কি তার জন্ম হয়েছে একজন ঘৃণ্য ও পশুর পেট থেকে? তার স্ত্রী-কন্যাও কি ঘৃণ্য? তিনি বলেন, ঘরের বাইরে গেলে, বাজারে গেলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে, চাকরি করতে গেলে কি এদেশের মেয়েরা জেনা করেন? গার্মেন্টস এর শ্রমিকরা কষ্ট করে সংসারের জন্য অর্থ উপার্জন করেন; তারাও কি জেনা করেন? এই ঘৃণ্য-অবমাননাকর বক্তব্য তিনি কীভাবে উচ্চারণ করেন?
বেবী মওদুদ বলেন, এইসব পাপী, বিকৃত রুচি সম্পন্ন অশ্লীল শব্দ উচ্চারণকারী, ধর্মের নামে যার ব্যবসা, তিনি তো হজ বা ওমরা করতে যান, সেখানে বিশ্বের সব দেশে নারী-পুরুষ একসাথে চলাফেরা করেন। তাহলে কি সেখানে নারী দেখে তার জিভে পানি আসে? তাহলে সেটাও পাপ। তাহলে আমরা সেই পাপের আমরা বিচার চাই। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দিয়ে যারা মিথ্যাচার করে বেড়ায়, তাদের এবং তাদের যারা সমর্থন করেন সেইসব পাপীদের আমরা শাস্তি চাই।
সরকার দলীয় সংসদ সদস্য বাপ্পী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ওই জঘন্য বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অথচ বিরোধী দলীয় নেত্রী অত্যন্ত নিশ্চুপ। এ বিষয়ে কোনো কথা-বার্তা বলছেন না। বিরোধী দলের নারী সংসদ সদস্যরা চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। তখন ভেবে দেখুন আহমদ শফী ঘরে থাকতে বলছেন। আপনার দলের নেত্রী এবং আপনাদের অবস্থা কী হবে, কোথায় থাকবেন আপনারা? আহমদ শফীকে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। নতুবা বাংলাদেশের নারী সমাজ আহমদ শফীকে ক্ষমা করবে না। আহমদ শফীকে যারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন, লালন-পালন করছেন তাদেরও বিচার হবে।
বাপ্পীর বক্তব্যের শেষে মওদুদ আহমেদ, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, পাপিয়াসহ বিরোধীদলীয় সাংসদরা দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বক্তব্য দেয়ার জন্য মাইক চাইতে থাকেন। স্পিকার বিরোধীদলীয় সাংসদদের পরে কথা বলতে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তারানা হালিমকে মাইক দেন। বিরোধী দলের মহিলা সদস্যদের প্রতিবাদের সমালোচনা করে তারানা হালিম বলেন, বিরোধী দলের যে সংসদ সদস্যরা চিৎকার করছেন, তারা প্রচ্ছন্নভাবে নারীকে অবমাননা করে দেয়া বক্তব্যের সমর্থন দিচ্ছেন। একজন নারী হিসেবে আমি লজ্জিত হচ্ছি। আজ যখন জাতিগতভাবে নারীদের আঘাত করা হয়েছে তখন বিরোধী দলের সদস্যরা বিপরীতধর্মী অবস্থান নিয়ে চিৎকার করছেন এটা আমাকে মর্মাহত করছে। এরপর মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বেবী মওদুদ যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন বিরোধী দলের সদস্যরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলেন। আপনাদের এই অট্টহাসি কি প্রমাণ করে না যে, হেফাজতে সাথে, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করছেন, একাত্মতা ঘোষণা করছেন? প্রধানমন্ত্রী ওই বক্তব্যের সমালোচনা করলেও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া কেন ‘চুপ’- তা জানতে চান প্রতিমন্ত্রী।
চুমকির পর মওদুদ আহমেদকে বক্তব্য দেওয়ার আহবান জানালে তিনি বলেন, আগে পাপিয়া বলবেন। সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়া বলেন, আল্লামা শফী সাহেবকে এই সরকারের আমলে বিভিন্ন পদ-পদবী, বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আজ হঠাৎ করে এই পার্লামেন্টে শফী সাহেবকে নিয়ে আলোচনার কারণ কী, জানতে চাই? আল্লামা শফী সাহেবের নামে যে বিবৃতিটি ছাপা হয়েছে শফী সাহেব তার ব্যাখ্যা দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। উনি বলেছেন, আমি যে কথা যেভাবে বলেছি মিডিয়া ক্যু এর মাধ্যমে সেই কথা সেভাবে প্রকাশিত হয় নাই’। পাপিয়া দাবি করেন, আল্লামা শফীর ১৩ দফা দাবির মধ্যে নারীর নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না। শাহবাগীরা মাসের পর পর বসে থাকবেন। আর হেফাজত বসতে পারবে না। বাংলাদেশের মাটিতে এটা হতে পারে না।
নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে এই সাংসদ বলেন, “বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন আমরা সার্থক করেছি। তাহলে কেন আবার নারীকে মধ্যযুগে ঠেলে ফেলার জন্য এইসব ধর্মব্যবসায়ীরা গ্রাম-বাংলায় বয়ান দিয়ে চলেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব, এই পাপীরা, যারা সংবিধানবিরোধী কথা বলেন- এটা দেশদ্রোহিতার শামিল। এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি দেয়া হোক।”
হেফাজতে ইসলামকে বিরোধী দল বিএনপির সমর্থনের সমালোচনা করে ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী বলেন, “তিনি (শফী) নারীকে ঘরের ভেতর আবদ্ধ থাকতে বলেছেন। তিনি যাদের সাথে জোট বেধেছেন কিংবা যে নেত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থান করেছেন, শত শত কোরআন পুড়িয়েছেন, বায়তুল মোকাররম মসজিদে হামলা চালিয়েছেন, সেই নেত্রীর ডাকে যখন সাড়া দেন কিংবা আর্থিক সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন সেই নেত্রীকে দেখলেও কি আপনার জিভে জল আসে?”
হেফাজত নেতার ওয়াজের সমালোচনায় এই সাংসদ বলেন, “আহমদ শফীর এ ধরনের বক্তব্য নোংরা-কদর্য ও সভ্যতা বিবর্জিত। আহমদ শফীকে বলতে চাই যে নেত্রীর কথায়, উসকানিতে আপনি বিকৃত অবস্থান নিয়েছেন, আপনার রক্ষা নাই। আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। যারা আহমেদ শফীকে উস্কানি দিয়েছেন তাদের ক্ষমা নাই।”
তার এ বক্তব্যের সময় সামনের সারিতে বসা বিরোধী দলের নারী সদস্যরা এর প্রতিবাদ করেন। এ সময়, সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়া খালি গলায় চিৎকার করে স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এখানে বিরোধীদলীয় নেত্রীর নাম কেন আসছে? মাইক বন্ধ করতে পারেন না?”
বাপ্পী আরো বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ওই জঘন্য বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অথচ বিরোধী দলীয় নেত্রী অত্যন্ত নিশ্চুপ। এ বিষয়ে কোনো কথা-বার্তা বলছেন না। বিরোধী দলের নারী সংসদ সদস্যরা চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। তখন ভেবে দেখুন আহমদ শফী ঘরে থাকতে বলছেন। আপনার দলের নেত্রী এবং আপনাদের অবস্থা কী হবে, কোথায় থাকবেন আপনারা?
“আহমদ শফীকে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। নতুবা বাংলাদেশের নারী সমাজ আহমদ শফীকে ক্ষমা করবে না। আহমদ শফীকে যারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন, লালন-পালন করছেন তাদেরও বিচার হবে।”
Leave a Reply