বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ১২:৪৩

ইরানে রমজানে বাংলাদেশকে খুঁজে ফেরা

ইরানে রমজানে বাংলাদেশকে খুঁজে ফেরা

মুমিত আল রশিদ: আলুর চপ, পেঁয়াজি, বেগুনি, জিলাপি, হালিম, ছোলা-মুড়ি ও খেজুর বাঙালি জীবনের অপরিহার্য ইফতারি উপাদান। তেহরানের বুকে সপরিবারে বসবাসরত বাঙালি ভাইদের খুঁজে বের করা ও জোরপূর্বক ইফতারির দাওয়াত নেওয়া রমজান মাসে আমাদের মতো ছাত্রদের অপরিহার্য কাজ। ইরানিদের সঙ্গে আমাদের ইফতার সংস্কৃতির কিছুটা পার্থক্য থাকায় এই পন্থা অবলম্বন করা। তবে সেহরি ও অন্যান্য রীতিনীতিগুলোতে কিছুটা হলেও অভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।

সেহরির সময় নির্ধারণ ও সেহরির রীতিনীতি অতীতে সময় নির্ধারণের ধারণাটি অনেকটা বাংলাদেশের প্রাচীন রীতিনীতিই মতোই ছিল। ঘড়ি না থাকার কারণে লোকেরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেহরির সময় সম্পর্কে অবহিত হতেন। কেউ কেউ আকাশের তারকারাজির ওপরে নির্ভর করতেন। তাঁরা দোবে আকবর (The Big Dipper or The Seven Stars or Seven Brothers), মিযান (একধরনের সময় পরিমাপক যন্ত্র) ও পারভিন বা সোরাইয়া (The Pleiades or Seven Sisters) তারকা দেখে সেহরির সময় নির্ধারণ করতেন।

এ ছাড়া আরেকটি মাধ্যম ছিল মোরগের ডাক। ইরানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন বিশ্বাস করেন, মোরগ রাতের দীর্ঘ পরিসরে তিনবার ডাক দেয়। প্রথমবার অর্ধ রাতে, দ্বিতীয়বার অর্ধ রাত পার হওয়ার পর ও সর্বশেষ ভোরবেলা। আর এ কারণেই নিজেদের বাড়িতে মোরগ রাখা কল্যাণ ও বরকতের প্রতীক মনে করতেন। সাধারণ লোকজন বিশ্বাস করতেন, আরশে এলাহিতে বৃহৎ ও সাদা রঙের একটি মোরগ রয়েছে যেটা প্রত্যুষে নিজের ডানা ঝাঁপটায় এবং উচ্চ স্বরে আজান দেয়। এই আজানের ধ্বনি পৃথিবীতে অবস্থানকারী সকল মোরগের কানে পৌঁছে যায়। তারা এই আজানের অনুকরণে নিজেরাও আজান দেয় ও লোকজনকে ভোর সম্পর্কে অবহিত করে।

অতীতে লোকজনকে জাগ্রত করার আরও একটি পদ্ধতি ছিল, সেটা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের মতো একটি দল পাড়া বা মহল্লায় ঢোল ও গজল সহকারে জাগ্রত করা। সিরজান অঞ্চলে এই দলটি লোকদের বাড়ির দরজায় টোকা দিয়ে জাগ্রত করতেন। টোকা দিতে দিতে বাড়ির মালিককে সম্ভাষণ করে কবিতা আবৃত্তি করতেন। রমজান মাস যদি গ্রীষ্মকালে হতো তবে বলত—ওহে বয়োজ্যেষ্ঠ উঠুন সেহরি খাই,/ খাই বরফ, চিনি মিশ্রিত ফালুদা আর তো সময় নাই!

এতিমদের সঙ্গে ইফতার করছেন প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানিশীতকালে মাহে রমজান হলে দলটি বলত—ওহে বয়োজ্যেষ্ঠ উঠুন সেহরি খাই/ খাই মধু মিশ্রিত মাখন, তেল সময় তো আর নাই!

এই গোষ্ঠীটি রমজান মাসের শেষ দিনগুলোতে সকলের বাড়ি ও দোকানে যেতেন ও লোকদের কাছ থেকে উপহার, হাদিয়া বা ঈদি গ্রহণ করতেন। এই হাদিয়া গ্রহণ করতে গিয়েও দলবদ্ধভাবে কবিতা আবৃত্তি করতেন। বুশেহর প্রদেশে এরা দোম দোম সেহরি নামে পরিচিত। এরা রমজানের রাতগুলোতে দাম্মাম (এক প্রকারের তবলা) বাজিয়ে লোকজনকে জাগ্রত করেন।

আবার কেউ কেউ বিশ্বাসী ছিলেন যে, ঘুমের সময় যদি মাটির কসম খাওয়া হয় তবে সেহরির সময় জাগ্রত হওয়া যাবে। যেমন কেরমান প্রদেশের সিরজান অঞ্চলের লোকজন ঘুমের আগে আঙুল দিয়ে মাটিকে আঘাত করে বলেন, হে মাটি আমার পাপ তোমার ঘাড়ে, সেহরির সময় আমাকে জাগ্রত কর।

অধিকাংশ শহরগুলোতে ধর্মভীরু ব্যক্তি নিজেদের বাড়ি বা মসজিদের ছাদে চলে যেতেন এবং উচ্চ স্বরে মোনাজাত করে রোজাদার লোকদের রোজা রাখার জন্য জাগ্রত করতেন। ছন্দোবদ্ধ কবিতা বা মোনাজাতে খাজা আবদুল্লাহ আনসারি বা শেখ সাদির কবিতা অথবা গ্রামীণ কবিদের কবিতা ছিল মোনাজাতের মূল উপাদ্য।

ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পূর্বে মোনাজাতকারী সবাইকে সতর্ক করে দিতেন এই বলে যে, হে মুমিনগণ! শুধুমাত্র কিছু জল পান করতে পারবেন। কোনো কোনো এলাকায় তারইয়াক টানার (একধরনের আফিম বা গাঁজা জাতীয় জিনিস তবে নিষিদ্ধ নয়, সাধারণত ধূমপানের মতো মামুলি ছিল) প্রচলন ছিল। তাদের উদ্দেশ্যে বলতেন, জল পান করুন ও তারইয়াক পান শেষে মুখ পরিষ্কার করে নিন।

আবার কোনো কোনো অঞ্চলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সেহরির সময় জাগ্রত করা হতো। সেহরির সময় জাগ্রত করার জন্য একবার ও সেহরির সময় শেষ হওয়ার আগে একবার এই বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো।

প্রযুক্তির উৎকর্ষে এগুলো প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে কিছু অঞ্চল ব্যতীত শুধুমাত্র বেতার, টেলিভিশন ও মসজিদে ঘোষণা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সতর্ক করা হয়।

হজরত আলীর (রা) জন্য শোক প্রকাশ রমজান মাসের ১৯, ২০ ও ২১ তারিখের দিন ও রাতগুলোতে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রথম ইমাম ও ইসলামের চতুর্থ খলিফা আমিরুল মোমেনিন হজরত আলী (রা) শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের রীতিনীতি ও শোক প্রকাশ পালন করা হয়। লোকজন সিনে যানি বা বুক চাপড়িয়ে ও মর্সিয়া গেয়ে শোক প্রকাশ করেন।

এই রজনীগুলোতে বড় বড় মসজিদের আশপাশের রাস্তাগুলোতে উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়। ধর্মভীরু লোকজন সপরিবারে সারা রাত রাস্তায় অবস্থান ও দোয়া-প্রার্থনা করে সেহরির পূর্ব মুহূর্তে বাসায় ফিরে যান।

২১ রমজান ইরানের সর্বত্র সরকারি ছুটি পালিত হয়। ধর্মীয় নগরী মাশহাদ ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে এই দিনে সৃষ্টির কোনো কিছুকে আঘাত করা ও কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এমনকি এই দিনে পশুপালকগণ গাভি ও ভেড়ার দুগ্ধ সংগ্রহ থেকেও নিজেদের বিরত থাকেন। গাভি ও ভেড়াগুলোকে তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে চারণভূমিতে নিয়ে যান না, পাছে বাচ্চাগুলো গাভি ও ভেড়ার সব দুধ শুষে নেয়।

রমজান মাসের অন্যান্য রীতিনীতি ১৯, ২১ ও ২৩ রমজানের রাতগুলো শিয়া সম্প্রদায়ের দলিল দস্তাবেজ অনুযায়ী শবে কদরের রাত হিসেবে গণ্য করা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ এই রাতগুলোকে জীবন্ত রাত হিসেবে অভিহিত করেন এবং সেহরি পর্যন্ত না ঘুমিয়ে কাটান। এই রাতগুলোতে প্রার্থনা ও বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগি করে রাত অতিবাহিত করেন। বিশেষ করে এইরাতে লোকজন জওশন কাবির নামে একটি প্রসিদ্ধ দোয়া পাঠ করেন। দোয়ার প্রতি বন্ধনীর পর পুরুষেরা উচ্চ স্বরে বলেন, আল গাউস, আল গাউস, খাল্লাসনা মিনান নার ইয়া রব ইয়া রব।

জিলাপি ও বামিয়ে বিক্রয়ের দৃশ্যরমজান মাসের শেষ রাতগুলোতে খোদা হাফেজ মাহে রমজান নামে একটি অনুষ্ঠানও এখানকার বিভিন্ন শহরে প্রচলিত রয়েছে। এই অনুষ্ঠানটি কোনো কোনো শহরে ২৭ রমজান, আবার কোনো কোনো শহরে রমজান মাসের শেষের দিকের সেহরির পরপর আবার কোথাও কোথাও মাগরিব ও এশার নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয়। লোকেরা মসজিদে অথবা ওই এলাকার প্রসিদ্ধ একজনের বাড়িতে জড়ো হন এবং বিদায় নামক প্রসিদ্ধ কবিতা পাঠ করে রমজানকে বিদায় জানান।

একসময় রমজান মাসের রাতগুলোতে বিশেষত প্রথম রাত থেকে ১৫তম রাত পর্যন্ত অনেক শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ইফতারের পর যুবকেরা একত্র হতেন। তাদের মধ্য থেকে একজন দলনায়ক নির্বাচিত হতো। ওই দলনায়ক পাড়া বা মহল্লার বাড়িগুলোতে গিয়ে আত্মিক প্রেরণামূলক কবিতা আবৃত্তি করতেন। বাড়ির মালিক তথা বাড়ির গৃহকর্ত্রী যিনি পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকতেন। তিনি মিষ্টি, ফলমূল ও অজিল বিশেষ করে কিশমিশ, তোখমে, আখরোট, বাদাম, কলুচেহ তাকে প্রদান করতেন।

ইরানের বৃহত্তম ধর্মীয় নগরী মাশহাদে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র আবু সালেহ জানালেন, শিয়া সম্প্রদায়ের অষ্টম ইমাম হজরত ইমাম রেজার (আ) মাজারে প্রতিদিন একজন আন্তর্জাতিক কারি পবিত্র কোরআন থেকে এক পারা করে তিলাওয়াত করেন এবং তাঁর সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে কণ্ঠ মেলান। ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা এটি সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে।

এ ছাড়া এখানকার বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে।

কুলে মারজান উৎসব: হজরত আলীর (রা) হত্যাকারী ইবনে মুলজাম মোরাদিকে ২৭ রমজান হত্যা করা হয়। সে কারণে এই দিনে ইরানি জনগণ আনন্দোৎসব পালন করে থাকেন। মারকাযি প্রদেশের খোমেইন শহরের ফারনাক ও খোমেইন শহরের পাহাড়ের পাদদেশের লোকজন ইবনে মুলজামের প্রতি শ্লেষ ও ভর্ৎসনা দিবস পালন করে থাকেন। উল্লেখ্য, আজ থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে সাইরাস দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর হাখামানশি রাজত্বে রাজ্য পরিচালনা প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। এ সময় গিউমাত নামক একজন মগ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রাজ্য শাসনে বসেন। পরবর্তীতে যখন দারয়ুশ বুঝতে পারেন, তখন তিনি গিউমাতকে এই প্রতারণার ফলস্বরূপ হত্যা করেন। সৌরবর্ষের মেহর মাসের ৮ তারিখে এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়। ওই সময়ে এটি ছিল পারস্যবাসীর সর্বোৎকৃষ্ট ঈদ। এই দিনে মগ গোষ্ঠীর যাকেই পেতেন পারস্যবাসী তাকেই হত্যা করতেন। ইতিহাসে একে মগ কোশি বা মগ হত্যা নামে পরিচিত। ইবনে মুলজামের প্রতি এই অভিসম্পাত দিবস এই মগ কোশির অনুরূপ একটি আনন্দমুখর দিন।

ইফতার সংস্কৃতি: এখানকার ইফতার সংস্কৃতি অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। বিশেষত মসজিদকেন্দ্রিক ইফতার। আবু সালেহ জানালেন, মাশহাদে অবস্থিত শিয়া সম্প্রদায়ের অষ্টম ইমাম হজরত ইমাম রেজার (আ) মাজারে প্রতিদিন ১২ হাজার লোক একসঙ্গে ইফতার করে থাকেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকেন।

তেহরানের রাস্তায় বের হলে দেখা যায় বড় বড় কোম্পানিগুলো নিজস্ব অর্থায়নে সকলের জন্য ইফতারির আয়োজন করছে। ইরানিদের মূল ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের একটি হচ্ছে অশ বা ঝোল বা স্যুপ। পুরো ইরানে যেসব অশ বা ঝোল বা স্যুপ তৈরি হয় তার মধ্যে অশে রেশতে (কাশক বা এক ধরনের দুগ্ধজাত দ্রব্য, শিমের বিচি, বুটের ডাল ও বিভিন্ন প্রকারের ছোলা দিয়ে তৈরি, ইরানের প্রসিদ্ধ স্যুপ), অশে দুগ (বোরহানি বা মাঠার স্যুপ), অশে মাস্ত (দইয়ের স্যুপ), অশে শাল্লে কালামকার, অশে জু (যবের দানার স্যুপ), অশে মিভে (ফল-ফলাদির স্যুপ), অশে তোরশ (টক জাতীয় স্যুপ), অশে আনার, অশে তারখিনে, অশে শালগাম, অশে গুরে ইত্যাদি। এগুলো তৈরির অধিকাংশ উপাদান হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার সবজি, শস্যদানা ও পেঁয়াজ। তবে অশে রেশতে পুরো ইরানে অধিকতর প্রসিদ্ধ ও অধিকতর সুপরিচিত অশ বা ঝোল বা স্যুপ, যা ইরানের প্রায় প্রতিটি শহরে তৈরি করা হয়। এই অশ শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী ও ধর্মীয় উৎসবেই সরবরাহ করা হয় না অধিকন্তু বছরের প্রতিটি ঋতু, বিভিন্ন প্রকার নাযরি বা বিনা মূল্যে সওয়াবের উদ্দেশ্যে বিতরণ ও ইফতারিতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মতো হালিমও এখানকার ইফতারে সকলের প্রিয় খাবার, যদিও স্বাদে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের মতো জিলাপিও এখানকার ইফতারে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বামিয়ে নামক সুস্বাদু মিষ্টি দ্রব্যটিও দারুণ মজাদার খাবার। রুটি, পনির, খেজুর ও বিভিন্ন রকমের সুগন্ধি পাতার কাঁচা সবজি ইরানিদের ইফতারের টেবিলে অপরিহার্য খাবার।

উল্লেখ্য উপরোক্ত নিয়মরীতিগুলো কিছু কিছু এলাকায় সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হয়। সময় ও যুগের সঙ্গে সঙ্গে রীতিনীতিগুলো পরিবর্তিত রূপ পরিগ্রহ করেছে।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025