আবু বকর সিদ্দিক: মওসুমী ফল, বিভিন্ন জাতের সবজি ও দেশী বিদেশী মাছসহ পচনশীল ভোগ্য পন্যে ফরমালিনের ব্যবহার মানুষের মধ্যে আতংক দিন দিন বাড়িয়েই তুলছে। বাজার থেকে অধিক মূল্যে তাজা বা ফলের রং ভালো দেখে কিনে নেয়ার পর বাসায় যখন খাবারের জন্য পরিবেশন করা হয় তখন এর রং এর সাথে স্বাদের কোন মিল না থাকছেনা।
ক্রেতারা তখন এটাকে ফরমালিনের প্রভাব বলেই ধরে নিচ্ছেন। আর এভাবেই ফরমালিন ভীতি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। কোন কোন ফল বাসায় নেওয়ার পর কয়েকদিন চলে যাওয়ার পরও যখন নষ্ট হচ্ছেনা তখন সন্দেহ আরো বাড়িয়ে তুলছে তাদের। এই প্রভাবে অনেক পরিবারের লোকজন বাজার থেকে ফল ক্রয় করছেন না। গত দুদিন সিলেটের কয়েকটি ফলের বাজার ঘুরে জানা গেলা ফরমালিনের ব্যবহার ও ক্রেতাদের অনীহার এমন অনেক অভিযোগের কথা জানা ।
বাজারে বর্তমানে আমের সরবরাহ ব্যাপক। কিন্তু মানুষের মধ্যে ফল ক্রয়ের যে প্রবনতা সেটা অনেক কম। বিক্রেতারাও তেমনটা জানিয়ে বলছেন আমরা ফরমালিনের ব্যবহার জানিনা, করিওনা। যারা আমাদের সরবরাহ করে তারা যদি ফরমালিন দিয়ে দেয় তা আমাদের জানা নেই। ক্রেতাদের এমন অনীহা আর অভিযোগ থাকলেও সরকারী খাদ্য মান নিয়ন্ত্রন সংস্থা বিএসটিআই জানিয়েছে আমরা চলতি মওসুমে সিলেটের বাজারে অভিযান চালিয়েছি, আমাদের পরীক্ষায় কোথাও ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
বিএসটিআই আরো দাবী করে আম, মাল্টা, কমলা,আপেলে কোন ফরমালিন নেই। তবে অন্য একটি ভোক্তা অধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষনের ফলাফল- হচ্ছে কিছু ফলে ফরমালিন ব্যবহার কমলেও রসালো ফলে ফরমালিনের বদলে রং বদলানো যায় এমন ভিন্ন একটা ক্যামিকেল ব্যবহার করা হচ্ছে। যা ধরা বেশ কঠিন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সংস্থার কর্মকর্তা জানিয়েছেন এজন্য অত্যাধুনিক পরীক্ষা যন্ত্র প্রয়োজন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাজারে যে সব ফল বিশেষত আম বিক্রির জন্য দোকানে সাজিয়ে রাখা হয় সেগুলো একদিন পরেই লাল রং ধারণ করে। যা দেখে বুঝার উপায় নেই এটি পাকা নাকি ক্যামিকেল মিশ্রনের ফলে এমন রং ধারণ করেছে।
এর কারন জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানান, আম সব সময় এরকমই হয়। এছাড়া অনেক দোকানে বিক্রি না হওয়াতে সাজানো আম বেশ কয়েকদিন রাখার পরও সেগুলো পচেনা বা রং বদলয়না। বন্দরবাজারের খালিক ফ্রুটস এর কর্মকর্তাকে এর কারন জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
একই প্রশ্ন করছিলাম রিকাবীবাজারের ভ্রাম্যমান আম বিক্রেতা সমিরণ দাশকে তিনি এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, আমি কদমতলি আড়ৎ থেকে কাচা অবস্থায় আম নিয়ে বাসায় ভিন্ন পদ্ধতিতে সাজিয়ে রাখি। যে দিন নিয়ে আসি পরদিন সকালে কাচা আমগুল্ইো লাল হয়ে যায়। আকারে ছোট এবং অপরিপক্ষ আমগুলোও গাছের পাকা আমের মতোই রং ধারন করার এই রহস্য সম্পর্কে জানকে চাইলে কেউই কোন উত্তর দিতে পারেননি। একই অবস্থা আপেলের ক্ষেত্রেও বাহিরে ভালো দেখা গেলেও অধিকাংশ আপেলের ভেতরের কিছু অংশ শুন্য, কোনটির ভেতরের অংশ শক্ত পাওয়া যাচ্ছে। এতে ফরমালিনের প্রভাবেই হচ্ছে এমন ধারনা করছেন ভোক্তারা।
অনুন্ধানে আরো জানা যায়, পবিত্র রমজান মাসে দেশীয় মাছের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না হওয়াতে বিদেশ থেকে মাছ আমদানি করতে হচ্ছে। আর বিদেশী এসব মাছে ফরমালিন এর প্রভাব একেবারে স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার সিলেটের কাজিরবাজারের মাছ বাজারে মৎস অফিস ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনকারী সংস্থার এক অভিযানে ভারত থেকে আমদানি করা রুই ও মৃগেল মাছে ফরমালিন পাওয়া যায়। কিন্তু মৎস বিভাগের পরীক্ষা যন্ত্রটির বিষয়ে বাজারের ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুললে সেদিনের অভিযান স্থগিত করা হয়। শুধু কাজির বাজারই নয়, ভারত থেকে এসব মাছ এখন সিলেটের অন্যান্য জেলা উপজেলা সদরেও সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে ফরমালিন খেয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন লোকজন।
এ ব্যাপারে ‘কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ক্যাব)সিলেট অফিসের পরিচালক জামিল চৌধুরী জানান, ফরমালিন ক্ষতিকর, এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়েছে।এটা ভালো দিক তবে এটাও ঠিক যারা ফরমালিন মেশানোয় জড়িত তাদেরও বুঝা উচিত এই কাজের দ্বারা আমি পুরো জাতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছি। তিনিও ফলে ফরমালিনের ব্যবহার কমেছে জানিয়ে বলেন, আম, আপেল ও অন্যান্য ফলে গত কিছুদিন পরীক্ষা করে কোন ফরমালিন পাওয়া যায়নি।
তবে রসালো ফলে অন্য রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত থাকতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।এজন্য উন্নত মানের মেশিন ব্যবহারের জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট সিলেট আঞ্চলিক অফিসের প্রধান পরিচালক মো. রেজাউল হক জানান, আমরা গত কয়েক দিনে সিলেটের বাজার ও অন্যান্য তিন জেলার ফলের বাজারে অভিযান চালিয়ে কোথাও ফরমালিনের ব্যবহার পাইনি। কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও আমরা তাদের শাস্তি দিয়েছি। তিনি সবাইকে ফল নিয়ে ভীতি দূর কথা জানিয়ে বলেন, অতীতে ফলে যে পরিমানে ফরমালিন ব্যবহার হতো এখন তা একে বারেই কমে এসেছে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুও গত ৮ জুন ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন ছয় ধরনের ফলে কোন ফরমালিন নেই।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্য মতে মানব শরীরের জন্য ফরমালিনের গ্রহনযোগ্য মাত্রা হলো শুন্য দশমিক পনোরো পিপিএম। অথচ বাংলাদেশে বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তন সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করেছে ২ পিপিএ। যা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে ১৪ গুন বেশি। বাংলাদেশে খাদ্যে ফরমালিন বিরোধী অভিযানে নিরাপদ খাদ্য আইনের (২০১৩) ২৩ ধারাকে ব্যবহার করা হয়।এতে উল্লেখ আছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য [যেমন; ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট) কীটনাশক (ডিডিটি,পিসিবি তেল) বা অন্য কোন দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্য দ্রব্য মজুদ, বিপণণ বা বিক্র করা যাবে না।