মোহাম্মদ আবিদুর রহমানঃ নান্দনিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কেম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ। এখানে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারী। যেটিকে ‘বাংলার সোনারখনি’ বলা হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে বন্যার তোড়ে নদী ও ছড়া দিয়ে প্রচুর পাথর এই কোয়ারিতে জমা হয়। যা সারা বছর উত্তোলন করে থাকেন শ্রমিকরা। ভোলাগঞ্জের এই পাথুরে রাজ্য চমৎকার। শুধু পাথর নয়, পাহাড়ের মনোরম সৌন্দর্য আরেক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এখানে আছে থরে থরে সাজানো পাহাড়। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের ওপারে ভারতের চেরাপুঞ্জি ও শিলংয়ের অবস্থান। এখানে ১৮৬৪ সালে সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। বৃটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন। এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হয়। তবে বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব ও বিকল ইঞ্জিনের কারণে এক্সক্যাভেশন মেশিন বন্ধ রয়েছে। আগে উত্তোলিত পাথর ভাঙ্গা, ধোয়া ও টুকরোর আকার অনুসারে বালু, স্টোন চিপস ও ট্রাক ব্যালাস্ট ইত্যাদি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো। শ্রেণী অনুসারে সেগুলো পৃথক পৃথকভাবে বের হয়ে রোপওয়েতে ঝুলানো চারকোনা বিশিষ্ট ষ্টীলের বাকেটে জমা হতো। পাথর ভর্তি বাকেট পাঠানো হতো ছাতকে।
মজার ব্যাপার হলো, এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে প্ল্যান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। রোপওয়ের এরিয়া প্রায় একশ’ একর। আর এ কারণেই স্থানটি পর্যটকদের কাছে এত আকর্ষণীয়। ভোলাগঞ্জ সীমান্তে হাঁটুপানির নদীতে হাঁটলে চোখে পড়বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য পাথর। মনে হবে যেন ছবির মত সুন্দর। মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে একটিই শব্দ অসাধারণ। -দুরের পাহাড়গুলোর উপর মেঘের ছড়াছড়ি, সাথে একটা দুটো ঝর্না। নদীর টলমলে হাটু পানির তলায় দেখা যায় বালুর গালিচা। চিকমিক বালু আর ছোট বড় পাথর মিলে এখানে যেন তৈরি হয়েছে পাথরের রাজ্য।
পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান ভারতের পাহাড়ী রাজ্য মেঘালয়ে। ধলাই নদীর উজানে এ রাজ্যের অবস্থান। খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় ঘেরা এ রাজ্যের দৃশ্য বড়ই মনোরম। ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে এলাকায় অবস্থান করে পাহাড় টিলার মনোরম দৃশ্যাবলি অবলোকন করা যায়। বর্ষাকালে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি ধলাই নদীতে পাহাড়ী ঢলের সৃষ্টি করে। ভোলাগঞ্জ কোয়ারীতে শুষ্ক মওসুমে প্রধানত গর্ত খূঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে শ্রমিকরা প্রথমে কোয়ারীর ওপরের বালি অপসারণ করে। পর্যায়ক্রমে গর্ত খুঁড়ে নিচের দিকে যেতে থাকে। ৭/৮ ফুট নিচু গর্ত খোড়ার পর কোয়ারিতে পানি উঠে যায়।
এসময় শ্যালো মেশিন দিয়ে কোয়ারীর পানি অপসারণ করে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করে। এর বাইরে শিবের নৌকা পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের উপায় হচ্ছে একটি খালি নৌকায় শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন লাগানো হয়। ইঞ্জিনের পাখা পানির নীচে ঘুরতে থাকে। পাখা অনবরত ঘুরতে ঘুরতে মাটি নরম হয়ে পাথর বেরোতে থাকে। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও খুব উপভোগ্য।
ভোলাগঞ্জে রয়েছে একটি ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন। এ স্টেশন দিয়ে আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম চলে। এ স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা প্রধানত চুনাপাথর ও কয়লা আমদানী করে থাকেন। চুনাপাথর নিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সীমান্তের জিরো লাইনে এ কাস্টমস স্টেশনের অবস্থান। চুনাপাথর আমদানির দৃশ্য অবলোকনের বিষয়টিও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
সবমিলিয়ে বলা যায় যে, সিলেটের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে; যদি সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে ভোলাগঞ্জ হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন ও উৎকর্ষময়ী পর্যটন কেন্দ্র। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।