বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০১

চোরাইরাজ্য হরিপুরে সাম্রাজ্যের পতন

চোরাইরাজ্য হরিপুরে সাম্রাজ্যের পতন

চোরাইরাজ্য হরিপুরকে এবার আর ছাড় দিলো না প্রশাসন। চোরাচালানিদের হেডকোয়ার্টার বলে পরিচিত হরিপুর বাজারকে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকশ’ দোকানপাট ভেঙে ফেলা হয়েছে। চোরাকারবারিরা নেই হরিপুরে। হাওয়া হয়ে গেছেন।

অনেকেই বলছেন, সেনা ভয়ে চিহ্নিত চোরাকারবারিরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত পালিয়েছে। হরিপুরের উপর প্রশাসনের দৃষ্টি পড়ায় সীমান্ত এলাকায়ও চোরাচালান কমে এসেছে। জৈন্তাপুরে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হরিপুর। সিলেট নগর থেকে বেশি দূর নয় ওই এলাকা। নানা কারণে এই এলাকা বিখ্যাত। একযুগ বা তার একটু আগের।

হরিপুর বাজারকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে চোরাকারবারিরা সরব হয়ে ওঠে। প্রথমেই তারা চোরাই পশুরহাট নিয়ে ব্যবসা চাঙ্গা করেন। পাঁচ বছর আগে পশুর হাট ছাপিয়ে চিনির চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিণত হয় এ বাজার। মূলত চোরাই চিনির মাধ্যমে হরিপুরের পার্শ্ববর্তী হেমু, হাউদপপাড়া, হরিপুর, বালিপাড়া সহ ৮ থেকে ১০টি গ্রামের মানুষ চোরাই সিন্ডিকেটে সম্পৃক্ত হয়ে যান।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, চোরাই ব্যবসা করে বৃহত্তর হরিপুরে ঘরে ঘরে এখন কোটিপতি। চোরাই সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় ছিল প্রশাসন। চোরাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে বার বার হামলার শিকার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এজন্য হরিপুরে অভিযান চালাতে ভয় পেতেন বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।

এবারের ঘটনা ছিল ভিন্ন। তুচ্ছ একটি ঘটনায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপর হামলা চালিয়েছে চোরাই সিন্ডিকেট। হামলায় যোগ দেন বাজারের বর্তমান সভাপতি হেলাল উদ্দিন, সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ, চোরাই পশুর চালানের মালিক ফারুক আহমদ, আলমগীর হোসেন সহ কয়েকজন। এ সময় তারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের মারধর করে আহত করা ছাড়াও তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে।

এ ঘটনায় গুরুতর আহত সেনা সদস্যদের হাসপাতালে ভর্তি করে ওই রাতে হরিপুরে ব্লক রেইড চালায় সেনা সদস্যরা। আটক করে অন্তত ২৮ জনকে। এর মধ্যে পাঁচজনকে থানায় সোপর্দ করে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়। সেনা সদস্যদের পক্ষে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল মতিন ৭০ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন।

তবে ঘটনার মূলহোতা বলা হচ্ছে ছয়জনকে। ঘটনার পর থেকে তারা লাপাত্তা। এরা হচ্ছে- হরিপুর বাজারের চোরাই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুর রশিদ, বাজার সভাপতি হেলাল উদ্দিন, সাবেক সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ, সাবেক যুবদল নেতা ফারুক আহমদ ও ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি আজিজুর রহমান আজির ও ফারুকের ব্যবসার অংশীদার আলমগীর। ঘটনার পর থেকে সেনাবাহিনী তাদের খুঁজছে।

হরিপুর বাজারের ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, চিহ্নিতরা ঘটনার পর থেকে এলাকা ছাড়ে। প্রথম দিন তারা সিলেটে থাকলেও সেনাবাহিনীর ভয়ে গোয়াইনঘাটের পেঠুয়া এলাকা দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে চলে গেছে। এমনকি অনেকের আত্মীয়স্বজনরাও এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।

হরিপুরের পশুর হাট গোটা দেশে চোরাই হাট হিসেবে পরিচিত। এই বাজারে পশু উঠলেই বৈধ হয়ে যায়। ফলে দিনে অন্তত ৪-৫ কোটি টাকার চোরাই পশু এই হাটে বিক্রি হতো। কিন্তু প্রশাসনের কোনো অনুমতি ছিল না এই বাজারে। স্থানীয়রা বাজারের টাকা লুটেপুটে খেয়েছেন। কিছু টাকা দিয়েছেন মসজিদে।

সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনার পর প্রথমেই চোখ দেয়া হয় অবৈধ পশুর হাটে। জৈন্তাপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শনিবার অভিযান চালিয়ে পশুর হাট উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় সেখান থেকে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এসব স্থাপনা থেকে বাজার কর্তৃপক্ষের নামে চাঁদা আদায় করা হতো।

হরিপুর বাজার ব্রিজের উভয়পাশে সড়ক ও জনপথের জমি দখল করে অন্তত দুই শতাধিক পাকা, আধা পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কের উভয় পাশে দুইশ’ ফুট করে জমির মালিক সওজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এই জমি জোরপূর্বক দখল করে ব্যবসা করা হচ্ছিল। এমনকি কয়েকটি বহুতল মার্কেটও নির্মাণ করা হয়। ব্রিজের মুখ থেকে তারুহাটি এলাকা পর্যন্ত পুরোটাই অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সিলেট-তামাবিল সড়ককে ৬ লেনে উন্নীত করতে জৈন্তাপুর প্রশাসন ও সওজ কর্তৃপক্ষ এসব অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে বার বার নির্দেশ নিলেও হরিপুরবাসী এতে কর্ণপাত করেননি। ঈদের পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎ হরিপুরে সেনাবাহিনীর মাইকিং। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জর্জ মিত্র চাকমার বরাত দিয়ে সেনা সদস্যরা মাইকিং করে সড়কের দু’পাশের অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন।

এতে হুলস্থ্থুল পড়ে এলাকায়। তিন ঘণ্টার মধ্যে মালামাল সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পেরেছেন ট্রাক, পিকআপযোগে তাদের মালামাল সরিয়ে নেন। রাতে বিরতি দিয়ে গতকাল সকাল থেকে অভিযান শুরু করে উপজেলা প্রশাসন।

হরিপুর বাজারের চোরাচালান ও অবৈধ স্থাপনা নিয়ে জিরো টলারেন্সে প্রশাসন। গতকাল সকাল থেকে শুরু হওয়া এই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চলবে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জর্জ মিত্র চাকমা।

তিনি জানিয়েছেন, ৬ লেন সড়কের কাজের জন্য এই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাজারের ভেতরের পশুর হাটটি অবৈধ হওয়ায় সেটিও উচ্ছেদ করা হয়। একইসঙ্গে অবৈধ স্ট্যান্ডসহ যত অবৈধ কর্মকাণ্ড সবকিছুর বিরুদ্ধে প্রশাসন অভিযান চালাচ্ছে।

এদিকে, উপজেলা প্রশাসনের এই অভিযানে সহযোগিতায় রয়েছে পুলিশ প্রশাসন। জৈন্তাপুর থানার ওসি আবুল বাশার মো. বদিউজ্জামান জানিয়েছেন, মামলা দায়েরের পর থেকে চোরাকারবারিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে উচ্ছেদ অভিযানেও পুলিশ সহায়তা করছে।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025