বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৫

ধর্মীয় সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত নন্দা নগরের শেষ মুসলিম

ধর্মীয় সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত নন্দা নগরের শেষ মুসলিম

লন্ড্রির দোকান চালিয়ে কোনোরকমে দিনগুজার করেন আহমাদ হাসান। প্রতিদিন সকাল ৮টায় এসে তার সেই লন্ড্রির (ড্রাই ক্লিনিং) দোকানের বাদামী রঙের শাটার তুলে দেন।

জীবন-জীবিকার একমাত্র সম্বল এ দোকানটি হিমালয়ের পাদদেশে নন্দাকিনী নদীর তীরে নন্দা নগর নামে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডের একটি প্রত্যন্ত শহরে অবস্থিত।

আহমাদ হাসান তার গ্রাহকদের জামাকাপড়গুলো সুন্দর করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে প্লাস্টিক ব্যাগে করে গুছিয়ে দোকানের গোলাপি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর ৪৯ বছর বয়সি এই ব্যক্তি অপেক্ষা করতে থাকেন গ্রাহকদের জন্য।

প্রতিদিন দুপুর হওয়ার আগেই ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক তার দোকানে আসতেন—শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট আর শীতের কাপড় নিয়ে। কেউ কেউ এক কাপ চা খেতে খেতে রাজনীতি, কৌতুক, আনন্দ-বেদনার গল্প করতেন। তাদের বেশিরভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের, মুসলিম গ্রাহকের সংখ্যা বেশ কম।

স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে এভাবেই বেশ চলছিল আহমাদ হাসানের লন্ড্রি দোকান ও জীবন সংসার।তবে তা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্তই।

তার পর থেকে এখন দুপুর পর্যন্ত হাতে গোনা চার-পাঁচজন হিন্দু ক্রেতা আসেন তার দোকানে। মুসলিম ক্রেতার তো নাম-গন্ধ মেলে না।

কারণ, আহমাদ হাসানই এখন নন্দা নগরে অবস্থান করা শেষ মুসলিম পুরুষ! কিন্তু কেন এ রকম হলো? কিভাবে হলো?

ঘৃণা হিংসার আগুনে পুড়ে যাওয়া শহর

জানা যায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই নন্দা নগরে ছিল ১৫টি মুসলিম পরিবারের বসবাস। এখানেই হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এখানকার হিন্দুদের উৎসবে যেমন নিমন্ত্রণ পেতেন, তেমনি ঈদেও অতিথি আসত তার বাড়িতে। মুসলিম হয়েও তিনি হিন্দু বন্ধুর শেষকৃত্যে কাঠের যোগান দিয়েছেন, আবার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন লাশ।

কিন্তু এসবই যেন হঠাৎ করে বদলে যায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে।এ সময়ে এক হিন্দু মেয়ের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সহিংসতা শুরু হয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে। যদিও অভিযোগ ছিল একজন মুসলিম সেলুন কর্মীর বিরুদ্ধে, কিন্তু দোষারোপ করা হয় পুরো একটি সম্প্রদায়কে।

একটি প্রতিবাদ মিছিল ঘৃণা-বিদ্বেষভরা ভাষণ আর মুসলিমবিরোধী স্লোগানে পরিণত হয়। যার জেরে মুসলিমদের দোকান ও ঘরে আক্রমণ করা হয়।ভয়-আতঙ্ক পেয়ে বসে তাদের, রাতারাতি শহর ছেড়ে পালিয়ে যায় তারা।

কেবল হাসানই ফিরেছিলেন পরিবারসহ। কারণ, এটাই যে তার একমাত্র পরিচিত জায়গা। যদিও গোটা পরিবারই এখন ভয়ের মধ্যে বসবাস করছে। কারণ, প্রতিবেশীরা কথা বলেন না। হাসানও আর নদীর পাড়ে হাঁটতে যান না। স্ত্রী-সন্তানদেরও কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে দেন না।

নন্দা নগরে টিকে থাকা একমাত্র এই মুসলিম বাসিন্দা বলেন, ‘আমি শুধু দোকানে যাই আর বাড়িতে ফিরি। এটাই এখন আমাদের ভাগ্য। এই শহরে পুরো জীবন কাটিয়ে এখন আমি যেন অদৃশ্য হয়ে গেছি’।

মুসলিমদের জুতো মারো

ঘটনার সূত্রপাত হয় এক মুসলিম সেলুন কর্মীকে নিয়ে।এক হিন্দু কিশোরী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলে, সে তাকে উত্যক্ত করেছে। এরপরই ওই সেলুন কর্মী পালিয়ে যায়। তবে শহরের ব্যবসায়ী সংগঠন প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেয়।

হাসানও মুসলিমদের নিয়ে সেই মিছিলে অংশ নেন, যাতে হিন্দুরা না ভাবে তারা অপরাধকে সমর্থন করছে। কিন্তু সেখানেই উঠতে থাকে—

‘মুসলিম দালালদের… জুতো মারো সালাদের’ স্লোগান।

এমনকি, হারুন আনসারি নামের এক মুসলিম যুবককে জনতা ধরে পেটায়। এ ঘটনার পর মুসলিমরা নিজ নিজ বাড়িতে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। এ সময় কয়েকশ’ জনতা তাদের বাড়িতে পাথর ছোড়ে।

রাত গভীর হলে হাসান দোকানে যান। দেখেন, দোকানের শাটার ভাঙা, জামাকাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে, টেবিল ভেঙে গেছে। এমনকি নগদ যে ৪ লাখ টাকা (রুপি) রাখা ছিল, তাও লুট হয়ে গেছে। টাকাটা তিনি সন্তানের বিয়ের জন্য জমিয়েছিলেন।

এখানেই শেষ নয়, পরদিন আরও বড় হামলা হয়। কয়েক হাজার মানুষ আসে, মসজিদ ভাঙে, এক মুসলিমের গাড়ি নদীতে ফেলে দেয়। পুলিশের চোখের সামনেই এসব ঘটে, কিন্তু তারা কিছুই করে না। উল্টো পুলিশ মুসলিমদের জানিয়ে দেয়, তারা আর তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবে না।

এসবের জেরে হাসানসহ সব মুসলিম বাসিন্দাকে একটি গাড়িতে করে অন্য শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তবুও আমি ফিরলাম

যাবতীয় হামলা-উচ্ছেদের পর হাসান ও মোহাম্মদ আয়্যুম নামের আরেক মুসলিম বাসিন্দা উচ্চ আদালতে সুরক্ষার জন্য আবেদন করেন। আদালত পুলিশের প্রধানকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন।

তবুও কেউ ফিরে আসেনি। কেবল হাসানের স্ত্রী একাই সাহস করে ফিরে আসেন। পরে হাসানও তার সঙ্গে যোগ দেন।

ফিরে এসে দেখেন, তার দোকানের সামনেই এক হিন্দু ব্যক্তি ড্রাই ক্লিনার খুলে বসেছেন। মুসলিমদের ওপর রয়েছে পুরোপুরি বয়কট। কোনো মিস্ত্রি তার দোকান মেরামত করতে রাজি হয়নি।

শেষ পর্যন্ত নিজেই দোকান ঠিক করে যদিওবা খুলেছেন—কিন্তু গ্রাহক নেই। পুরনো গ্রাহকদের ফোন করলেও কেউ আসেন না। যারাও বা আসেন, তাদেরকে ভয় দেখানো হয়।

এ নিয়ে হাসান বলেন, ‘সেদিনই বুঝলাম, লন্ড্রিরও ধর্ম আছে!’

আশার আলো

এদিকে হাসানের বড় মেয়ে স্কুলে গেলে সেখানে সে ধর্ম নিয়ে হেনস্তার শিকার হয়। বিষয়টি স্কুলে জানানো হলে তবেই বন্ধ হয়।

তবুও সেখানকার মুসলিমরা এখনো ন্যায়ের দেখা মেলেনি। সহিংসতার পর দায়ীদের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। মেলেনি কোনো বিচার।

তবে সম্প্রতি একদিন সেই বয়কট ভেঙে এক হিন্দু প্রতিবাদকারী হাসানের দোকানে আসেন পোশাক দিতে। তখন হাসানের স্ত্রী তাকে বলেন, ‘আপনিই তো আমাকে বোন ডাকতেন, আর সেই আপনিই কিনা আমাদের তাড়াতে চেয়েছিলেন?’

জবাবে কিছুটা লজ্জিতস্বরে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘পুরনো কথা ভুলে যাও, বোন। তোমাদের কাজ ভালো, তাই এসেছি।’

এ সময় হাসান সবাইকে বলেন, ‘আমি টিকে ছিলাম, তাই এই দিনটা দেখতে পেলাম।’

তবে পুরনো বন্ধুত্বের ভাঙন এখনো কষ্ট দেয় তাকে। হাসানের ভাষায়, ‘যখন অন্য মুসলিম পরিবারগুলো তাদের জিনিসপত্র নিতে ফিরে এসেছিল, তখন পুরনো (হিন্দু) বন্ধুরাই তাচ্ছিল্য করছিল। মনে হচ্ছিল, হৃদয়টাই ভেঙে যাচ্ছে।’

তবুও হাসান তার শহরকে ছাড়তে রাজি নন। বলেন, ‘এই শহরই আমার পরিচয়। এই জায়গা ছেড়ে আমি যাব কোথায়?’




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025