মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৯

তারানকো ফিরে গেছেন ক্ষীণ আশা নিয়ে

তারানকো ফিরে গেছেন ক্ষীণ আশা নিয়ে

শীর্ষবিন্দু নিউজ: সাবেক স্বৈরশাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে নিতে সরকার ৬০টি আসন প্রস্তাব করেছে। এটা তার পুরস্কার। এভাবে নির্বাচন হলে তা হবে নামকাওয়াস্তে। কিন্তু এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এরপরই ১২ই ডিসেম্বর তাকে তার বাসা থেকে নিয়ে গেছেন নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। লন্ডনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে।

পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ: দ্য হ্যাংম্যান হ্যাজ স্পোকেন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক সঙ্কট, এর সঙ্গে কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের কাছ থেকে ৪২ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধে নৃশংসতার দায়ে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী মহাসচিব আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হলো ১২ই ডিসেম্বর। যে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা ছিল ঠুনকো।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একই পরিবারের ৬ জনকে হত্যা করেছেন। এ বিষয়ে মাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ঘটনার সময় ওই সাক্ষীর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। তিনি একটি বিছানার নিচে লুকিয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এছাড়া, অধিকতর কোন প্রমাণ ছিল না। ওই ঘটনার পর থেকে কাদের মোল্লা মিরপুরের কসাই হিসেবে পরিচিত হন। কিন্তু তিনি এসব হত্যাকাণ্ডে ও অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত ছিলেন কিনা তা আর কখনও জানা যাবে না। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধ আদালত প্রথমে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে তার অনুপস্থিতিতে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু তারপর কাদের মোল্লা ছিলেন প্রথম আসামি। আসামির উপস্থিতিতে আদালত তাকেই প্রথম শাস্তি দিয়েছে। এ আদালত নামেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। আসলে এটি একটি অভ্যন্তরীণ আদালত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে এ আদালত গঠন করে। প্রথমে এ আদালত কাদের মোল্লাকে যে শাস্তি দেয় তাতে তার জীবন রক্ষা হয়েছিল। কিন্তু, তাতে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। দাবি ওঠে তার ও অন্য যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিতে হবে। যাদের বিচার করা হচ্ছে তার মধ্যে প্রায় সবাই জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সময়ের সিনিয়র নেতা। তাদের অনেকেই এখনও শাস্তি ভোগের অপেক্ষায় আছেন। কাদের মোল্লার শাস্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা একই সঙ্গে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তোলে। তারা যা চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন। কাদের মোল্লাকে প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

১৭ই সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সেই শাস্তিকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নভেম্বরে জামায়াতে ইসলামীকে আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিষিদ্ধ করে। এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে দুর্বল করে দেবে। সরকার পরিবর্তন হলে এ আদালত আর টিকে না-ও থাকতে পারে। এ আদালতের চারজন প্রসিকিউটর ও আদালতের তদন্ত সংস্থার প্রধান এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবেদন করেছেন। তবে তারা তাদের বর্তমান পদ ত্যাগ করে আসেন নি। এমন একটা পরিবেশ যেখানে সবাই মনে করেন বিচার বিভাগ হলো নির্বাহী বিভাগের অনুগত, সেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে পরিবর্তন করার জন্য বিদেশী স্বনামধন্য ব্যক্তিরা চেষ্টা করতে পারতেন।

নতুন তালগোল পাকানো পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে গত ১১ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ফোনে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তারা জানতেন, কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হলে তাতে আরও রক্তপাত হবে। এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে নিহত হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘর্ষে। আদালত নিশ্চিত জানতো এ রায় বাস্তবায়ন হলে দেশের পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে, নির্বাচন-ও কেমন নাম কা ওয়াস্তে হয়ে পড়বে। কিন্তু শেখ হাসিনা সমঝোতা করবেন না।

রাজনৈতিক অর্থে বলা যায়, এই ফাঁসি ভুল করে দেয়া হয় নি। আগামী ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন করতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিরোধী দল এ নির্বাচন বর্জন করা সত্ত্বেও সরকার নির্বাচন করবে। বিএনপি ও তার জোটের অন্য ১৭টি ছোট দল নির্বাচনে কোন মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি। এরই মধ্যে সরকার সাবেক স্বৈরশাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ৬০টি আসন প্রস্তাব করেছে। এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পুরস্কারস্বরূপ। এটা হলে সে নির্বাচন হবে নামকাওয়াস্তে। তবে এরশাদ সেই প্রস্তাব লুফে নেন নি। নির্বাচন থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

তারপরই ১২ই ডিসেম্বর রাতে তাকে তার বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। যদিও কাদের মোল্লার ফাঁসি জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভাঙার জন্য তাদের যে চেষ্টা তাতে চপেটাঘাত। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি যখন ক্ষমতায় তখন একই ভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। তখন জাতিসংঘ সতর্কতা দিয়েছিল যে, যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কৌশলপূর্ণ নির্বাচনে নিরাপত্তা দিতে পারে তাহলে তাদেরকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে লোভনীয় কাজ দেয়া হবে। জাতিসংঘের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়েছে। ততক্ষণে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের আকাশে সূর্য। বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তারা তখনকার প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে, নির্বাচন বাতিল করতে ও সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বাধ্য করেন।

জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এমন ছিল না। এবার সেই জাতিসংঘ আরও উজ্জ্বল উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসে। এবারের উদ্দেশ্য, সুষ্ঠু একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ উদ্দেশ্য নিয়ে, জাতিসংঘের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা আসেন দু’ দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য। নির্বাচন স্থগিত করার ক্ষীণ আশা নিয়ে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তিনি ঢাকা ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। যে সহিংসতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল তার মৃত্যুতে আরও রক্তপাত না ঘটিয়ে তা সুরাহার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সতর্ক করেছে। তারা বলেছে, এতে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পিছিয়ে পড়া মানুষ, হিন্দু সম্প্রদায় শিকারে পরিণত হতে পারে।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025