অনন্ত হক |
বিএনপিতে অসংখ্য জননেতা থাকলেও এখন প্রয়োজন যোগ্য সংগঠক, ওয়েবভিত্তিক ‘ইয়ংপলিটিক্যাল স্টাডি গ্রুপ’-এর সমীক্ষায় এমন কথাই বলা হয়েছে। সমীক্ষা বলছে, যদিও রাজনৈতিক দলে জননেতারাই সবচেয়ে দ্রষ্টব্য বা স্পেকটাকিউলার অ্যাসেট, তথাপি সংগঠকেরাই হলেন দলের অন্তরালবর্তী মূলস্তম্ভ। যেমন ক্রিকেট বা ফুটবলের কোচ। আসল খেলাটা তারাই খেলেন। বিএনপির রাজনীতির জন্য এখন তেমনই যোগ্য সংগঠকের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
ইয়ংপলিটিক্যাল স্টাডি গ্রুপ বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের একটি ওয়েভভিত্তিক ফোরাম, যার সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। ফোরামের পক্ষে পরিচালিত মতামত জরিপ প্রসঙ্গে অন্যতম সংগঠক ইকবাল হোসেন মিন্টু মানবজমিনকে জানান, আমরা সদস্যদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘কেন বিএনপির আন্দোলন আপাতত সফল হতে পারেনি’? এ প্রশ্নে ৪৮৭ জন অংশগ্রহণকারী মতামত প্রদান করেন। তাদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা ৫টি কারণকে গুরুত্বের ক্রমানুসারে তালিকাভুক্ত করেছি।
এগুলো হলো- ১. যোগ্য-সংগঠকের অভাব। অতীতে বি. চৌধুরী, আ. সালাম তালুকদার, কে এম ওবায়েদ, আ. মান্নান ভূঁইয়া এবং খন্দকার দেলোয়ার যেভাবে সংগঠনের পেছনে কাজ করেছেন, এমনটি এখন হচ্ছে না। দলের বিভিন্ন স্তরে ও কাঠামোয় বহু জন নেতা দেখা গেলেও সাংগঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন কাউকে দেখা যায়নি। ফলে আন্দোলন সুসংগঠিত করা সম্ভব হয়নি।
২. অবসরপ্রাপ্ত ও অরাজনৈতিকদের প্রাধান্য। দলে অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও ব্যবসায়িকদের প্রাধান্য প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাসম্পন্নদের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। এই শ্রেণীর নেতৃত্ব সংগঠনকে দৃঢ় করার মাধ্যমে সরকারবিরোধী কার্যকরী রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে।
৩. মূল দল এবং প্রায় সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ স্থানেই পূর্ণাঙ্গ শাখা গঠন করা হয়নি বলে আন্দোলনের মাঠে সংগঠিতকর্মীদের তৎপরতা ছিল না বললেই চলে। ৪, সাংগঠনিক গতিশীলতার তীব্র অভাব রয়েছে। আন্দোলনের আগে ঢাকা ও অন্যান্য মহানগরীতে কর্মিসভা বা বর্ধিত সভার মতো প্রস্তুতিমূলক কোন কার্যক্রমই গৃহীত হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সফরের মাধ্যমেও কোনরূপ সাংগঠনিক গতিশীলতা আনয়ন করা হয়নি। ৫, কেন্দ্র ও তৃণমূল পর্যায়ে জোটের মধ্যে সমন্বয় ও নেটওয়ার্ক ভালোভাবে কাজ করেনি। ফলে আন্দোলনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, অবিশ্বাস ও যোগাযোগহীনতার সৃষ্টি হয়েছিল।
‘ইয়ংপলিটিক্যাল স্টাডি গ্রুপ’-এর সমীক্ষায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেছে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির সাফল্য-ব্যর্থতা প্রসঙ্গে। প্রায় সকল উত্তরদাতাই বলেছেন যে, বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল যেমন স্পষ্ট ছিল না; প্রস্তুতিও যথেষ্ট ছিল না। বিএনপির কার্যক্রমে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ছিল। প্রথমে মনে হয়েছে, তারা হেফাজতকে ভর করে আন্দোলনে বিজয়ী হতে চায়। পরে জামায়াতকে এবং সর্বশেষে বিদেশী দূতদের ওপর ভরসা করছে বলে মনে হয়েছে। নিজের শক্তি ও সামর্থ্যকে সপ্রমাণিত করতে পারেনি বিশাল জনসমর্থনপুষ্ট দলটি। অনেকেই বলেছেন যে, বিএনপির মধ্যে ‘অতি-আস্থা’র সৃষ্টি হয়েছিল। তারা ক্ষমতায় যাচ্ছেই, এমন মনোভাব এসেছিল। ফলে অনেকেই গা বাঁচিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এমন মনোভাব দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্য, কার্যক্রম ও বডিল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে।
‘ইয়ংপলিটিক্যাল স্টাডি গ্রুপ’-এর সমীক্ষায় বিএনপির সাংগঠনিক সাফল্যের জন্য দলে প্রয়োজনীয় শুদ্ধি অভিযানসহ দলীয় কাঠামো ও নেতৃত্বের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নৈতিক বল ও মানসিক শক্তি যে ভাবে ভঙ্গুর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে, সেটাকেও পুনরুদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। সাংগঠনিক কাঠামো ও নেতৃত্বের দুর্বলতা অপসারণ করে যথাযথ সক্রিয়তা ও প্রণোদনা সৃষ্টি করা না গেলে সামনের দিনগুলোতে বিএনপির পক্ষে অর্থবহ আন্দোলন করে সফল হওয়া কঠিন হবে। সমীক্ষায় অংশ নেয়া একজন একটি বিখ্যাত চিনাপ্রবাদ উল্লেখ করেছেন, ‘সৈন্য কত অনুগত সেটা বড় কথা নয়, সৈন্য যুদ্ধ জানে কিনা, সেটাই বড় কথা।‘ প্রবাদের সঙ্গে সঙ্গে এ মন্তব্য করা হয়েছে যে, বিএনপির জন্য এখন অনুগত ও মোসাহেবদের বদলে যোগ্যদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ সাফল্যের প্রয়োজনে।