হুমায়ুন কবীর রিন্টু: নড়াইলের মহিলা ফুটবল দলের কথা এখন ক্রীড়াঙ্গনের সকলের মুখে মুখে। রাজধানী ঢাকা কিংবা বড় শহরগুলোতে মেয়েদের ফুটবল খেলা এখনও সেভাবে হয়নি। নড়াইল জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে শেখহাটি ইউনিয়নের হাতিয়াড়া, গুয়াখোলা ও বাকলি গ্রামের মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন প্রশিক্ষণ নিতে আসছে জেলা শহরে। তাদের দেখাদেখি শহরের আদিবাসী পাড়ার মেয়েরাও উৎসাহিত হয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১০ জন মেয়ে গত বছর ঢাকা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম মহিলা ফুটবল লীগে খেলে এসেছে। বিউটি, বিপাশা, রুনা, শর্মিলা ও রনি খেলেছেন ওয়ারী ক্লাবে, স্বরসতী, প্রতিমা, বিচিত্রা, শেফালী ও শ্যামলী খেলেছেন আরামবাগ ক্লাবে। এবারও বিভিন্ন ক্লাবে তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
নড়াইলে নারী ফুটবলের শুরু যেভাবে: তিন বছর আগের কথা। ২০১০ সালের জুলাই মাসে সদর উপজেলার শেখহাটি ইউনিয়নের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে প্রথম মহিলা ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়। এ ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা করেন, হাতিয়াড়া গ্রামের পুতুল মজুমদার, বিচিত্রা বিশ্বাসসহ আরও কয়েকজন। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় এবং স্থানীয়দের উৎসাহ আর নিজেদের চাঁদায় কেনা বল দিয়ে কিছুদিন অনুশীলনও করেন খেলোয়াড়েরা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২৪শে জুলাই স্থানীয় গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নামে দু’দল মেয়ে খেলোয়াড়। খেলা দেখতে দর্শকের ঢল নামল। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাওলাদার মো. রকিবুল বারী প্রধান অতিথি হয়ে এলেন খেলা দেখতে। এলেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারাও। বিবাহিত দলের বিপক্ষে অবিবাহিত মেয়েদের লড়াই। পরবর্তী সময়ে সদর উপজেলার শেখহাটি ইউনিয়নের ‘বাঁচতে শেখা’ গঠিত জ্যোতি নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে ইউনিয়নের গুয়াখোলা মাধ্যমিক স্কুলের মাঠে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার তালিকাভুক্ত কোচ কার্ত্তিক দাস। পরে নড়াইল শহরের কুড়িগ্রামের কুড়িডোব মাঠে এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্টেডিয়ামে নিয়ে আসা হয় এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। সে থেকে কুড়িগ্রামের কুড়িডোব মাঠে এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্টেডিয়ামে মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন কোচ কার্ত্তিক দাস। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য প্রয়োজন ছিল আর্থিক সহযোগিতার। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সাবেক জাতীয় ফুটবল তারকা শেখ আসলামও মেয়েদের ১০টি ফুটবল ও কিছু জার্সি প্যান্ট দিয়ে সহযোগিতা করেন। ফুটবল খেলায় আগ্রহ সৃষ্টি এবং মেয়েদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কার্ত্তিক দাস এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। দিনে দিনে বাড়তে থাকে মেয়ে ফুটবল খেলোয়াড়। ফুটবল খেলতে উৎসাহিত হয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে।
সাফল্য: ৫০-৬০ জন মেয়ে নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন করে। এদের মধ্যে বাছাই করে ৩০ জনকে বিশেষভাবে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপশি প্রতিদিন বেলা ৪টার দিকে প্রশিক্ষণার্থীরা হাজির হন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্টেডিয়ামে, আবার কখনও কুড়িডোব মাঠে। প্রশিক্ষণ চলে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। কখনও দু’দলে ভাগ হয়ে ম্যাচ খেলে, কখনও শরীর ফিটনেস, কখনও ফুটবলের নানা কৌশল শেখা। এভাইে চলছে নিজেদের যোগ্য ফুটবলার হিসেবে তৈরির চেষ্টা। ইতিমধ্যে মেয়েরা জেলা দলের হয়ে এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম ক্লাব কাপে খেলেছে। এছাড়া তিনজন খেলোয়াড় (বিপাশা, রুনা ও পদ্মাবতী) অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছে। এর মধ্যে পদ্মাবতী জাতীয় দলের হয়ে মালয়েশিয়ায় খেলেও এসেছে। এখানকার তিনজন মেয়ে জাতীয় অনূর্র্ধ্ব ১৪ দলের ক্যাম্পে রয়েছে।
ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তার কথা: প্রমীলা ফুটবল ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং বাঁচতে শেখার সহযোগিতায় নড়াইলে এমন একটি কাজ হচ্ছে, যা ক্রীড়া সংস্থার এত সাপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আয়োজন করতে পারেনি। এ টিম যদি নিয়মিত অনুশীলন করে এবং নতুন নতুন মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রতি উৎসাহিত করে তাহলে ফেডারেশন তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। তিনি বলেন, এই দলের তিনজন খেলোয়াড়কে জাতীয় অনূর্র্ধ্ব ১৯ দলের ক্যাম্পে ডাকা হয়। জাতীয় দলের হয়ে একজন বিদেশে খেলেও এসেছে। আশা করি আগামীতে এখান থেকে আরও খেলোয়াড় জাতীয় দলে জায়গা করে নেবে।
Leave a Reply