নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশকে সম্ভাবনার ভূমি হিসেবে দেখছে বহুদিনের পরীক্ষিত বন্ধু জাপান। কম খরচের এই দেশটিকে তাই তারা বিনিয়োগ ক্ষেত্র করতে চায়। এদেশের বহুমাত্রিক শিল্পায়নে সহায়তা করতে চায় এশিযার অন্যতম এই অর্থনৈতিক শক্তি।আগামী ৬ সেপ্টেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে এবার তাই বিনিয়োগের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।
এদেশে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে দুদেশের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাপানের উদার বৈদেশিক সহায়তা সম্পর্কিত পলিসি ডায়ালগ মিশনের সঙ্গে বাংলাদেশের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কিভাবে সহায়তা দেওয়া যায় সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রেণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, জাপানের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বড় মাপের কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আসিয়ানসহ চীন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে তাদের গার্মেন্টস কারখানাগুলোও তারা বাংলাদেশে স্থানান্তরের আগ্রহ দেখিয়েছে। এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশের সংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ এবং অপেক্ষাকৃত সস্তায় জনশক্তি পাওয়া যায়। এদেশের আইনগুলোও বিনিয়োগবান্ধব। জাপানের আগ্রহকে বাস্তবে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
গত মে মাসে টোকিও সফরের সময় শুধু জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য চট্টগ্রামে ৫০০ একরের একটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। সেসময় রপ্তানি প্রস্তুতকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও জাপানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (জেটরো) একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সে চুক্তি অনুসারে, জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য পাঁচটি ইপিজেডে ৪০টি প্লট ও দুটি ভবন জাপানের করা হয়েছে। জাপানের বিনিয়োগ আগ্রহের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নানা সুবিধার কথা বিবেচনা করেই জাপান এদেশকে বিনিয়োগক্ষেত্র তৈরি করতে চায়। এর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। সেটা বলতে রাজনৈতিক পরিবেশ যতটা বোঝায় তার চেয়ে বেশি বোঝায় নিরবিচ্ছিন্ন ‘পাওয়ার সাপ্লাই’। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সহজতর লাইসেন্স পারমিট আইনসহ নানা ব্যবসায়িক সুবিধা।
এ বিষয়ে মাতারবাড়িতে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সহায়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিল্পায়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি বিদ্যুৎ। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা তৈরি করতেই জাপান এ প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাপান দূতাবাস সূত্র জানায়, জাপানের প্রধানমন্ত্রী আগামী ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করবেন। এ সফরের প্রস্তুতি হিসেবে জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প উপমন্ত্রী নরিহিকো ইশিগুরো ঢাকা সফর করেছেন। এর আগে বাংলাদেশ-জাপান সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপে অংশ নেয়।
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণ প্রকল্পের তদারকিতে প্রথমবারের মত যৌথ কাঠামোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাপানের কর্মকর্তারা। প্রস্তাবিত কাঠামোর বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জাপানকে জানিয়েছে বাংলাদেশ। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে বাংলাদেশকে জাপান ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এ ঋণের অর্থে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের প্রস্তাব আছে বাংলাদেশের।
এর মধ্যে আছে গঙ্গা ব্যারাজ, যমুনা নদীর নিচে টানেল, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো শুধু রেলের জন্য আরেকটি সেতু, বহুমুখী ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস ও ঢাকার চারপাশে থাকা চার নদীর জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার মতো বৃহৎ অর্থায়নের প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোই বাছাই, সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্য যৌথ কাঠামো চাইছে জাপান।এছাড়া শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট ইনিশিয়েটিভ বা বিগ-বির বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন শিনজো আবে। তার ঢাকা সফরে এ বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব পাবে বলে মনে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন কূটনীতি বিশ্লেষকরাও। সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, জাপান বিরাট এক অর্থনৈতিক শক্তির নাম। এ দেশটি বাংলাদেশের পাশে থাকা বিরাট এক সুখবর। তারা বাংলাদেশে শ্রম মূল্য কমসহ ব্যবসায়ের নানা সুবিধা থাকায় তারা এদেশকে ‘ল্যান্ড অব অপারচুনিটি’ হিসেবে দেখছে। যার কারণে অন্যান্য ব্যয়বহুল দেশ থেকে তারা ব্যবসা উঠিয়ে আনতে চায়। এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সুখবর।
তবে এ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে বেশ সততা ও কর্মনিষ্ঠা দেখাতে হবে বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, জাপান অর্থনৈতিক বিষয়ে খুব সিরিয়াস। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তাদের আপত্তি থাকলেও যখনই সরকার এদেশে হরতাল, অবরোধসহ বন্ধ করে ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তখনই তারা বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। তাই বিনিয়োগের জন্য তাদেরকে সব ধরনের সুবিধা দিতে পারলে জাপান এদেশের শিল্পায়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। যুদ্ধপরবর্তী সময় থেকে নানা সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে পরীক্ষিত বন্ধুতে পরিণত হয়েছে জাপান। এবারও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যখন চারিদিকে ব্যাপকভাবে সমালোচিত, তখনও সরকারকে অভিনন্দিত করে জানায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথা। সে অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের জাপান সফরে ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। অথচ ১৯৭২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশ জাপান থেকে পেয়েছিল ৬০০ বিলিয়ন ইয়েনের কিছু কম পরিমান ঋণ।