বিনোদন ডেস্ক: সিনেমার একটি দৃশ্যে পাঞ্জাবী পুলিশ অফিসার নিজের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে, “মাইসেল্ফ শমসের সিং ফ্রম পাঞ্জাব’। শাহরুখের প্রশ্ন, “হুইচ পার্ট? সর্দারজির উত্তর, “হোল বডি’। এমন অসংখ্য হাস্যরসাক্তক দৃশ্যে ভরপুর চেন্নাই এক্সপ্রেস। সমালোচকদের মন্তব্য, হাসির এই ভান্ডারকে পুঁজি করেই বাজিমাত করছে চেন্নাই এক্সপ্রেস।
মুক্তির প্রথম তিনদিনেই ১০০ কোটি রুপি, আর প্রথম সপ্তাহেই ১৫০ কোটি পার। শুধু ভারতে প্রথম দশদিনেই ২০০ কোটির কাছাকাছি (১৮১.৯৩) কোটি। ভারতের বাইরে ৫০টি দেশে ইতিমধ্যে প্রথম নয় দিনে আয় হয়েছে ৯০ কোটি রুপি। সবমিলিয়ে খুব দ্রুতই চলে গেছে ২০০ কোটির ঘরে। অগ্রিম টিকেট পাওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কী আছে চেন্নাই এক্সপ্রেস’ সিনেমাটিতে, যার এত ব্যবসা, এত প্রচার-প্রসার?
কী আছে চেন্নাই এক্সপ্রেস কাহিনীতে? মুম্বাই নগরী। ট্রেনে উঠলেন রাহুল। মানে শাহরুখ খান। ট্রেনের গতি যখন দুরন্ত নায়িকা দীপিকা তখন ছুটন্ত। মানে দৌড়ে আসছেন ট্রেনের দিকে। শাহরুখ হাত বাড়ালেন দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে সিনেমার শেষ দৃশ্যের স্টাইলে। তবে কাজলকে টেনে তোলার মধ্য দিয়ে দিলওয়ালে দুলহানিয়া শেষ হলেও এখানে মাত্র শুরু। তামিল মেয়ে মিন্নামা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কারণ তার বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন অপছন্দের পাত্রের সাথে। বাবা আবার দুষ্টদের শিরোমণি।
শুরুতে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত নানা বিরোধ, বিপত্তি। তবুও কেমন করে যেন সম্পর্ক গড়ে ওঠে শাহরুখ-দীপিকার। ঝামেলার শুরু দীপিকার বাবার সুযোগ্য শিষ্যদের উপস্থিতি। দীপিকার বাবার পোষা গুন্ডাদের চোখ এড়িয়ে বেশ কয়েকবার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পরও তাই শাহরুখ আর চলে যায় না। শেষমেস গিয়ে উপস্থিত হয় দীপিকাদের গ্রামে। এর মাঝেই কমেডি, অ্যাকশন। হয়ে ওঠে সাসপেন্স, থ্রিল, অ্যাডভেঞ্চার, অ্যাকশন আর মিষ্টি রোমান্সের এক অসাধারণ ককটেল।
ব্যাটে বলে টাইমিং ঈদে ছবি মুক্তি মানেই সুপারহিট। ব্যপারটা গত কয়েকবছর ধরেই প্রমাণ করছেন সালমান খান। দাবাং, বডিগার্ড আর এক থা টাইগার- গত তিন ঈদের তিন ছবিই ১০০ কোটির ওপরে আয়। শাহরুখ ছিলেন দীপাবলীর খেলোয়াড়। তবে এবার ঈদে সালমানের ছবি নেই। ব্যস, ফাঁকা মাঠে বল লুফে নিয়ে এগিয়ে গেলেন শাহরুখ। ঈদের দিনকয়েক পরেই আবার ভারতের জাতীয় দিবস। আর সিনেমার নায়ক যেহেতু শাহরুখ সেহেতু আলাদ ক্রেজ তো আছেই। লাখো ভক্ত’র পাশাপাশি কৌতুহলী দর্শকের ও দৃষ্টি বলিউড বাদশা এবার কী করেছেন? সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে যেমন চার হয়, এ বেলায় ব্যাটে বলে টাইমিং মিলে হয়ে গেল একদম ছক্কা।
বিহান্ড দ্যা সিন রোহিত শেঠি’র গোলমাল থ্রি দেখে আরো অনেকের মতো মুগ্ধ হয়েছিলেন শাহরুখ খানও। দর্শক বিনোদন দেয়ার মত এমন একটা সিনেমা তারও করা চাই। প্রস্তাব দিলেন রোহিতকে। আর সে মতোই তৈরি হলো স্ক্রীপ্ট। ঠিক পছন্দ হলো না। ঘষেমেজে স্ক্রীপ্ট করা হলো। নায়ক তো ঠিক। কিন্তু নায়িকা কে? রোহিতের সফল হওয়া অন্যান্য সিনেমার মত এখানেও কারিনাকে নেয়ার কথাই এলো প্রথমে। কোন এক কারণে কারিনা বাদ। কাহিনী যেহেতু দক্ষিণ ভারতের ওপর ভিত্তি করে, ভাষা ব্যবহারের একটা ব্যপার আছে। এবার বিবেচনায় অসিন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল প্রথম দ্বিতীয় কোন পছন্দই টিকল না। থার্ড চয়েজ দীপিকা-ই হয়ে গেলেন নায়িকা। আর সমালোচকদের চোখে চেন্নাই এক্সপ্রেস সিনেমার বড় পাওনা দীপিকার স্বতস্ফুর্ত অভিনয়।
সোনার ডিম পাড়া হাঁস রোহিত শেঠি। চেন্নাই এক্সপ্রেস সিনেমার পরিচালক। অ্যাকশন আর কমেডি মিশিয়ে ককটেল চলচ্চিত্র বানান। তাই সিনেমা সমালোচকরা খুব একটা আনন্দ প্রকাশ করেন না রোহিতের ছবি দেখে। অথচ গোলমাল থ্রি, বোল বচ্চন আর সিংহম এর মত ছবি কিন্তু তারই করা। বলিউডের এ পর্যন্ত যতগুলো সিনেমা ১০০ কোটির ঘরে পৌঁছেছে তার মধ্যে চেন্নাই এক্সপ্রেসসহ চারটি সিনেমার পরিচালকই রোহিত। যেখানে অন্য কোন পরিচালকের নেই দুটিও।
বেশ কবারই রোহিত শেঠি বলেছেন তার সিনেমা কমন পাবলিক এর জন্য তৈরি। তার সিনেমা টাকা কামানোর জন্য তৈরি। যেখানে বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই মূল কথা। চেন্নাই এক্সপ্রেস সিনেমাতে সোনার ডিম পাড়া হাঁস আছে আরো একজন। তার নাম আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। পুরো সিনেমাটিকেই তো ডাকা হচ্ছে শাহরুখ এক্সপ্রেস বলে।
আয় বাড়ানোর অলিগলি যেকোন চলচ্চিত্রের মূল আয় প্রেক্ষাগৃহে। চেন্নাই এক্সপ্রেস মুক্তি পেয়েছে ভারতের বাইরে আরো ৫০টি দেশে। ভারতে ৩৭০০ আর বাইরে ৭০০ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে সিনেমাটি। ভারতের বাইরে বলিউডের আর কোন সিনেমা এত বেশি দেশে মুক্তি দেয়া হয়নি। আবার ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি, জার্মান, হিব্রু সহ ১০টি বিদেশি ভাষায় ও ডাবিং করা হয়েছে চেন্নাই এক্সপ্রেস-র। সবমিলিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে আয় দৃশ্যমান। এর বাইরে স্যাটেলাইট স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৪৮ কোটি টাকায়। নোকিয়া-ম্যাকডোনাল্ডের মতো ১৮ টি ব্র্যান্ডের সহযোগিতা (টাই আপ) থেকে আয় ৩০ কোটি। প্রথম প্রিভিউ থেকে আয় হয়েছে আবার প্রায় ৭ কোটি রুপি। আর সিনেমা মুক্তির আগে মিউজিক প্রচার থেকে তো আয় ছিলই। অথচ এত এত আয়ের এই সিনেমাটি নির্মাণে বাজেট ছিল মাত্র ৭৫ কোটি রুপি।
সমালোচকদের চোখে সমালোচকরা ছবি দেখেন গল্প, নির্মাণ, অভিনয়, সামাজিক প্রভাব, বৈশ্বিক সংস্কৃতি-এসব মাথায় রেখে। তাদের কাছে সময়ের সাথে তাল মেলানো মানে ননসেন্স। চেন্নাই এক্সপ্রেস ও ব্যতিক্রম কিছু নয়। তবে সমালোচকরাই সব নয়। চেন্নাই এক্সপ্রেস নিয়ে সমালোচকদের চোখে বড় দাগে ধরা পড়েছে সিনেমাটির প্রায় অর্ধেকজুড়েই তামিল ভাষার ব্যবহার। যেটি অনেকের জন্যই বুঝতে অসুবিধার। কারণে অকারণে অ্যাকশনের সমালোচনাও অনেকের মুখে। বলিউডের অন্যান্য সিনেমার মত এখানেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্দায় নায়কের উপস্থিতি। প্রয়োজন মতো নায়িকা তাল মিলিয়ে গেছেন। সবকথার বড় কথা একদম বিশেষ কিছু হয়নি, চলে যায়- টাইপের।
বিনোদনই যেখানে আসল শাহরুখ কিন্তু রোমান্স করায় পটু। সালমান খানের মত পেশিবহুল শরীরও নেই, সেই অ্যাকশনও নিশ্চয়ই নেই। তবে দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে যে অনেক কিছুকে সামাল দেয়া যায় সেটাও দেখাতে পারলেন শাহরুখই। মস্তিস্কের মধ্যে সব রকমের মানবিক যুক্তিবোধ নিয়ে চেন্নাই এক্সপ্রেস দেখতে বসলে চরম আশাহত হতে হবে। আর দশটা বলিউডি সিনেমার মত। কিন্তু লক্ষ্য যখন হবে শুধুই বিনোদন তখন তা পাওয়া যেতে পারে ষোল আনা-ই।
সমালোচকরাও যা স্বীকার করছেন। বক্স অফিস বিশেষজ্ঞ তরণ আদর্শ বলেছেন, চেন্নাই এক্সপ্রেস সমালোচকদের খারাপ লাগলেও দর্শকদের ভালো লেগেছে। বক্স অফিসে ওটাই শেষ কথা।
কেন দেখবেন চেন্নাই এক্সপ্রেস কিংবা কেন এত হইচই? সব প্রশ্নেরই উত্তর একটাই, এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারটেইনমেন্ট এবং এন্টারটেইনমেন্ট।
Leave a Reply