আইন আদালত ডেস্ক: আমাদের দেশে একটি কন্যাশিশু বেড়ে ওঠার সময় তাকে সামাজিক যেসব নির্যাতন-নিপীড়ন প্রতিরোধ করতে হয়, তা তার জীবনের প্রতি হতাশা নিয়ে আসে বলে মনে করছেন নারী অধিকারকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
তারা বলছেন, বাল্যবিয়ের মধ্য দিয়ে মেয়েশিশুকে যে হয়রানির মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি তার সারাজীবনের জন্য ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। একদিকে তাদের শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যেতে হয়, অন্যদিকে কোনও কোনও চাকরি যোগ্যতায় অবিবাহিত হতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ।
২০১৬ সালে সংসদে টেবিলে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য বেগম লুৎফা তাহেরের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে ২০১১ সালের আদমশুমারি বরাত দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশে বর্তমানে কন্যাশিশুর সংখ্যা (শূন্য থেকে ১৭ বছর) দুই কোটি ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৩৬ জন। ২০১৬ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী মেয়েশিশুর সংখ্যা দুই কোটি ৯৮ লাখ ৮১ হাজার বলেও মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
এ বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ, সে প্রশ্ন তুলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজ বলেন, নারীর লড়াই শুরু হয় কৈশোর থেকেই। এ সময়ে তার প্রতি সমাজ-পরিবার যে আচরণ করবে, পরবর্তী সময়ে ওই অভিজ্ঞতা নিয়েই তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা সেই সুরক্ষার জাযগা তৈরি করতে বারবারই ব্যর্থ হচ্ছি। এর বিপরীতেও নারীরা বারবারই সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে গিয়ে উদাহরণ তৈরি করেছে।
বাল্য বিয়ে
২০১৩ সালে আইসিডিডিআর,বি ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণায় বাল্যবিবাহের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয় দরিদ্র্য, নিরাপত্তার অভাব, পারিবারিক সমস্যা, বয়স বাড়লে যৌতুকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক চাপের মতো বিষয়গুলোকে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যায়, বাল্যবিয়ের কারণেই মেয়েদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি ৭৭%।
নারী অধিকারকর্মী খুশী কবীর বলেন, এসব কারণের কোনোটির জন্যই মেয়েশিশুটি দায়ী নয়। কিন্তু কুফল তাকেই ভোগ করতে হয়। বাল্যবিয়ের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেয়েরা, সামাজিক সুরক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে। অনিরাপদ এক জীবনের মুখোমুখি এসব মেয়ের নিজের জীবন বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
তিনি বলেন, এই বাল্যবিয়ে কেবল আইন করে বন্ধ করা সম্ভব না। বাল্যবিয়ে রোধের আইনটিও যে বাল্যবিয়ে কমাতে সক্ষম, এমন নয়।
চাকরি যোগ্যতায় নারীর বিয়ের স্ট্যাটাস
নাসিমার (ছদ্মনাম) বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সে। বিয়ের পর পড়ালেখা কিছুটা এগিয়ে নিলেও উচ্চশিক্ষা নেওয়া হয়নি তার। এরই মধ্যে ২২ বছর বয়সে তার স্বামী তাকে ছেড়ে বিদেশ চলে যায়। বেঁচে থাকার তাগিদে নাসিমা চাকরির সন্ধান করতে থাকেন। কয়েকটি জায়গায় সব যোগ্যতা থাকার পরও কেবল ‘বিবাহিত’ হওয়ায় চাকরি হয়নি তার।
এমন ঘটনাকে অধিকারের লঙ্ঘন ও সামাজিক নিপীড়ন হিসেবে উল্লেখ করেন নারীনেত্রী সালমা আলী। তিনি বলেন, ‘নারীকেই কেবল এসব যুদ্ধ করতে হয়। বেশকিছু চাকরি আছে যেগুলোর জন্য নারীকে অবিবাহিত হতে হয়। কিন্তু চাকরির জন্য কেন নারীকে বিবাহিত হতে হবে, সেই প্রশ্নটি তোলা জরুরি।’
জীবন যুদ্ধে মেয়ে শিশু
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩০টি। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৫। ২০১৬ সালে তা কিছুটা কমে হয় ২৮। কিন্তু ২০১৭ সালে গত ছয় মাসেই গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। রাজধানীর বিভিন্ন বাসায় স্থায়ীভাবে কাজ করা গৃহকর্মীদের বেশিরভাগেরই বয়স ৮ থেকে ১৪ বছর।
এসব গৃহকর্মীর নির্যাতনের চিত্র ভয়াবহ হলেও কেবল শ্রেণি বিভাজনের কারণে এদের নির্যাতন চাপা পড়ে যায় বলে মনে করেন শ্রমিকনেতা জলি তালুকদার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্যাতনের ঘটনায় বেশিরভাগ মামলার সাক্ষী হাজির হয় না। ফলে মামলাগুলো ঝুলে যায়। এছাড়া প্রায় ক্ষেত্রে পুলিশ উদ্যোগী হয়ে দুই পক্ষের মধ্যে টাকার বিনিময়ে ফয়সালা করে ফেলে। ফলে গৃহশ্রমিকরা ন্যায্য বিচার পায় না।