নুরুজ্জামান লাবু |
ঢাকা মহানগর পুলিশের খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম হোসেনের গোপনে দেশ ত্যাগের বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে পুলিশ বিভাগে। বিব্রত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ছুটি ও অনুমতি ছাড়া ওসি শামীমের যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো নিয়ে খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই বিস্মিত। চাতুরি করে পেশায় ব্যবসায়ী দেখিয়ে পাসপোর্ট করেছিলেন শামীম। আর ওই পাসপোর্টেই নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করেন তিনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তার দেশত্যাগ নিয়ে সহকর্মীদের মাঝেও আছে নানা আলোচনা। কেউ বলছেন, দেশের ক্রান্তি সময়ে সুযোগ বুঝে তিনি কেটে পড়েছেন।
আবার কেউ বলছেন, খিলক্ষেত এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি অবৈধভাবে যে অর্থ আয় করেছেন, এর দায় এড়াতেই নিরাপদে দেশ ছেড়েছেন। দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ডিএমপি ও পুলিশ সদর দপ্তরে জমা পড়েছে। এসব অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন বলে আগেই কেটে পড়েছেন। গতকাল ওসি শামীমের বিদেশ যাওয়া নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তার এভাবে গোপনে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওসি শামীমের চাতুরি করে ব্যবসায়ী হিসাবে পাসপোর্ট ও ভিসা নেয়ার বিষয়টির সত্যতা পেয়েছে পুলিশ কর্মকর্তারা।
এজন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশও করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। সাময়িক বরখাস্তের জন্য আইজিপির কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। পরে তদন্ত শেষে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হবে তাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ারও প্রক্রিয়া চলছে।
দীর্ঘদিন ওসি শামীমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা পুলিশের এক সদস্য জানান, প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই গোপনে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর জন্য পরিকল্পনা আঁটেন শামীম। এজন্য নিজের সরকারি পরিচয় গোপন করে ব্যবসায়ী হিসেবে একটি পাসপোর্ট তৈরি করেন। আমেরিকায় তার আপন বড় ভাই ও এক বোন থাকেন। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি আমন্ত্রণপত্র জোগাড় করেন তিনি। পরে সেই আমন্ত্রণপত্রের ভিত্তিতে স্ত্রী পাপড়ি ও দুই সন্তানকে নিয়ে আমেরিকান দূতাবাসে ভিসার আবেদন করেন। ভিসা পাওয়ার পর থেকেই তিনি কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তার বড় মেয়ে ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে চলতি বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলে প্রত্যয় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়তো।
খিলক্ষেত থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত ১৩ই ডিসেম্বর সর্বশেষ তিনি থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এদিন রাত ১২টার দিকে বুকে ব্যথার অজুহাতে তিনি এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হবেন বলে থানা থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় তার সরকারি মোবাইল ফোনটি পরিদর্শক (তদন্ত) আশরাফ উদ্দীনকে দিয়ে যান। পরদিন তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে অসুস্থতা বোধ করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। পরে ডিএমপি সদর দপ্তরের ডিসি (সদর) বরাবর ২৮ দিনের একটি সিক আবেদন (অসুস্থতাজনিত ছুটি) করে চলে যান। পরদিন সকালে তিনি সৌদি এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৯শে আগস্ট ওসি শামীম খিলক্ষেত থানায় বদলি হয়ে আসেন। এর আগে তিনি ফেনীতে ছিলেন। তারও আগে তিনি ডিএমপি, গাজীপুর জেলা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ আয় করেন। খিলক্ষেত থানায় যোগদানের পর থেকে তার সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় দুই আবাসন কোম্পানির মালিকের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়া খিলক্ষেত থানাধীন এলাকায় গড়ে ওঠা ছোট বড় একাধিক আবাসন কোম্পানির মালিকের সঙ্গে তার ‘সুসম্পর্ক’ ছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি এসব আবাসন কোম্পানির হয়ে কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে বহু নিরীহ মানুষের সম্পত্তি আবাসন কোম্পানির হয়ে দখল করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান বিভাগে এরকম একাধিক অভিযোগ জমা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, আবাসন কোম্পানির হয়ে সম্পত্তি দখল করে দেয়ার বিনিময়ে তিনি বিপুল অর্থ আয় করেন। ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় পাঁচ কাঠার একটি প্লট রয়েছে তার। এছাড়া তিনি ৪৭নং সিদ্ধেশ্বরীর একটি অ্যাপার্টমেন্টের সপ্তম তলায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকতেন। প্রায় এক কোটি টাকা দিয়ে তিনি ওই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন।
ওসি শামীমের ঘনিষ্ঠ এক পুলিশ সদস্য জানান, তার ঢাকায় আরও কিছু সম্পত্তি ছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক এসব সম্পত্তি তিনি বিক্রি করে আমেরিকায় ভাই ও বোনের কাছে অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে সিদ্ধেশ্বরীর ফ্ল্যাট, কাফরুলের বাড়ি ও পূর্বাচলের প্লটটি তিনি বিক্রি করেননি। কোন কারণে যদি দেশে ফিরে আসতে হয় এজন্য এসব সম্পত্তি তিনি রেখে দিয়েছেন। তবে ওই সূত্র জানায়, ওসি শামীম দীর্ঘদিন ধরে জমি বেচাকেনা ও দখল সংক্রান্ত কাঁচা পয়সা কামিয়েছেন।
ডিএমপির এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি কোন কর্মকর্তা তার পরিচয় গোপন করে অন্য পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করতে পারেন না। এমনকি বিদেশ যেতেও নানা প্রক্রিয়া ও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনে ছলচাতুরি করাটা ফৌজদারি অপরাধ। বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ওসির দেশত্যাগের গুঞ্জন উঠলে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে তার সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।