রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৬

ইউরোপের পথে পথে…

আ স ম মাসুম, প্যারিস থেকে

ডোভার ফেরিতে উঠতেই চোখের সামনে শান্ত নীল সমুদ্র দেখে মনে পড়ে গেলো ব্রজেন দাশের কথা। সেই সাতারু ব্রজেন দাশ, যিনি পাড়ি দিয়েছিলেন ইংলিশ চ্যানেল। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নাম লেখান ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দিয়ে। পিএন্ডও কোম্পানির স্পিরিট অব ব্রিটেন নামের জাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার জন্য যখন ফ্রান্সের কালাইয়ের উদ্দেশ্যে ছাড়লো তখন মনটা ভালো হয়ে গেলো ব্রজেন দাশের কীর্তির কথা ভেবে।

এর আগে আরো কয়েকবার প্যারিসে আসা হয়েছে। একবার গাড়িতে করে যাওয়ায় ফেরিতে গিয়েছিলাম আর বাকি কয়েকবার গিয়েছি ইউরো স্টারে। যদিও ইউরো স্টারে গেলে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে হয় তবে সেটা সমুদ্রের উপর দিয়ে নয়। সমুদ্রের নিচে তৈরি করা হয়েছে ইউরো টানেল। সুমদ্র আমাকে বরাবরই টানে। তাই সময় সংক্ষেপ হলেও দেড় ঘণ্টার সমুদ্র ভ্রমণটাই আমাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হলো।

২৫ মাইল সাঁতরে পাড়ি দেন ব্রজেন দাশ। আজকে থেকে ৬০ বছর আগে। মোট ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন তিনি। এরমধ্যে একবার ১০ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে পাড়ি দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন তিনি। বাংলাদেশ থেকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর এই পাড়ে একজন সতীর্থের এমন কীর্তি তো অবশ্যই গর্বিত করে তুলবে। সফরসঙ্গী ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাজ্জাদ আজীজ মালিক এবং আহাদ শাহ ব্রজেন দাশের কীর্তির কথা শুনে বলে উঠলেন, আসলে আমরা বাংলাদেশিরা খুব ক্রেজি জাতি। যেটা টার্গেট করি সেটা না হয়ে আর উপায় নেই! আসলেই তাই। নাহলে গত ২০ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত এই সাজ্জাদ আজীজ মালিক আর ফজলুল কবীর তুহিনের নেতৃত্বে ৭ জনের একটি টিম ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে মোট ৩০০ কিমি হেঁটে চলে আসেন যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান নিয়ে। তখন আবহাওয়া বিরূপ ছিলো। আমি নিজেও সেই হেঁটে আসায় সামিল হয়েছিলাম।সাজ্জাদ এবং আহাদ ছাড়াও সঙ্গে রয়েছেন নাট্য অভিনেতা, নাট্যনির্মাতা, আজ রবিবার নাটকে হুমায়ুন আহমেদের হিমু চরিত্রে রূপদানকারী ফজলুল কবীর তুহিন।

লন্ডন থেকে শিল্প-সাহিত্যের শহর প্যারিস, সেখান থেকে মন্টে কার্লে। মন্টে কার্লে একটা ছোট দেশ, যদিও ফ্রান্সের অধীনে তবে সবকিছুই আলাদা। প্যারিস থেকে ১০০০ কিলোমিটার ড্রাইভ। এটি অ্যারাবিয়ানদের কাছে বেশ প্রিয় একটি জায়গা। এখানে মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডকের ব্যবসায়ী অংশীদার সৌদি প্রিন্স আল ওয়ালিদ তালাত বিন আল সৌদের একটি অবকাশ যাপন ভিলা রয়েছে। এখানেই গ্রান্ড প্রিক্স ফর্মুলা ওয়ান মোটর রেইস হয়। মাত্র ৬ কিমি আয়তনের এই শহরকে তখন পুরো বন্ধ করে দিয়ে আয়োজন করা হয় ফর্মুলা ওয়ান। পৃথিবীর অন্যতম ব্যায়বহুল জায়গা। হোটেল ভাড়া প্যারিস বা লন্ডন নগরীর থেকে ৪ গুণ বেশি। সমুদ্র দেখতে দেখতে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম ফেরিতেই। চমৎকার ব্যবস্থা। হালাল এবং হারাম দুইটাই রয়েছে। যে যেটা খেতে চায় অসুবিধা নেই। তুলনামূলক একটু বেশি দাম হলেও ক্ষুধা যখন চরমে তখন কি আর সেটা মুখ্য হয়! পেট ঠাণ্ডা করে নীল পানি দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম আমরা। তুহিন ভাইতো চমৎকার গান করেন। শুরু হলো হাসন রাজা দিয়ে। ‘ছাড়িলাম হাসনের নাওরে…’ দেড় ঘণ্টার জার্নি কখন কিভাবে শেষ হলো বোঝাই গেলো না!

ফেরি থেকে নেমে আমাদের গন্তব্য প্যারিস। কালাই পার হয়ে কোন ইমিগ্রেশন নেই। ফ্রান্সে যে জিনিস আমাকে মুগ্ধ করে সেটি হচ্ছে তাদের হাইওয়ে। দুপাশের পরিবেশ আদতে একই রকম হলেও ব্রিটেন থেকে ফ্রান্সের হাইওয়ে অনেক ভালো। তবে হঠাৎ করে লেফট সাইডে চালাতে গিয়ে একটু হিমশিম খেতে হয় প্রথম ১৫/২০ মিনিট। ফ্রান্সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন চ্যানেল এ্স এবং একাত্তর টিভির ইউরোপ প্রতিনিধি নূরুল ওয়াহিদ। আমাদের গন্তব্য প্যারিসের প্লাস ডা ক্লিসি ক্যাফে লুনাতে। প্যারিসের অন্যতম ব্যয়বহুল স্থানে ইউরোপের বাংলাদেশী ধনকুবের কাজী এনায়েত উল্লাহ ইনুর অনেকগুলো রেস্টুরেন্টের একটি হচ্ছে এখানে। আমাদের প্যারিসের আথিতেয়তার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনিই। সাড়ে ৪ ঘণ্টার জার্নি শেষ করে যখন কাজী এনায়েত উল্লাহর উষ্ণ অভ্যর্থনা নিয়ে ক্যাফের ভিতরে গেলাম দেখি বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা, নাট্য নির্মাতা, বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল হোসেন তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে আছেন। আমাদের সফরসঙ্গী ফজলুল কবীর তুহিন আফজাল হোসেন নির্মিত মধুমতি লবণসহ কয়েকটি বিজ্ঞাপন চিত্রে কাজ করেছেন আবার আফজাল হোসেন ফজলুল কবীর তুহিনের ডিরেকশনে একটি নাটকে কাজ করেছিলেন। তাই তাদের দু’জনের মধ্যে সখ্য দীর্ঘদিনের।

রাত নয়টায় আমাদের মিটিং বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে। আমাদের কর্মসূচি ওয়াকিং ফর জাস্টিসের খবর মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশে বসেই তিনি অবগত ছিলেন। এবিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি মিটিং শেষ হলো আমাদের। সকালে উঠেই আমাদের গন্তব্য মন্ট্রে কার্লে বা মনাকোর উদ্দেশ্যে। দুপুর বারোটায় আমাদের যাত্রা শুরু করে গিয়ে পৌঁছালাম রাত ১২টায়। রাস্তায় ৪ বার থামতে হলো দুপুরের খাবার আর পেট্রল নেয়ার জন্য। ফ্রান্সে যে জিনিসটা আমাদের সবচেয়ে বিরক্ত করেছে সেটা হচ্ছে প্রতি ৫০/৬০ মাইলে আমাদের থামতে হয়েছে টোল দেয়ার জন্য। প্রত্যেকবার ২৫ ইউরো করে। টোল সংস্কৃতি ব্রিটেনের হাইওয়েতে নেই বললেই চলে।

মনাকোতে রাতে যখন পৌঁছালাম তখন সব খাবারের দোকান বন্ধ। প্রায় দুই ঘণ্টার ঘোরাঘুরির পর একটি কাবাবের দোকান খোলা পেলাম। সেটায় গোগ্রাসে গিলে ঘুমাতে গেলাম প্রায় ৩টায়।সকালে ৭টায় উঠে মিটিং বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উপর ট্রেনিং নিতে আসা ৬ জন জেলা পরিষদ প্রশাসক এবং বেশ কয়েকজন সচিবসহ ১৭ জনের একটি দলের সঙ্গে। আমাদের লক্ষ্য ব্রিটেন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে নিতে আমাদের ওয়াকিং ফর জাস্টিস কর্মসূচি সম্পর্কে অবগত করা এবং সরকার যেনো কার্যকরী ভূমিকা নেয় সেটার জন্য। এই সফরে রয়েছেন ফজলুল কবীর তুহিনের ছোট ভাই সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রসাশক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন। তিনিই এই মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আধা ঘণ্টায় মিটিং শেষ করে উনারা চলে গেলেন মিলানের উদ্দেশ্যে। আমরা ঘুরতে লাগলাম মন্ট্রে কার্লেতে।

পাহাড়ের উপর থেকে চমৎকার সমুদ্র সৈকতে আমাদের চোখ আটকে গেলো। নীল পাহাড় আর স্ফটিক সমুদ্র আমাদের বিষণ্ন করে তুললো। এতো সুন্দর! এতো সুন্দর!! ধারণার বাইরের সুন্দর অনেক সময় মনকে দ্রবীভূত করে বিষণ্নতার দিকে নিয়ে যায়। আমাদের সেটাই হলো। পুরো শহরে পুলিশ গিজ গিজ করছে! রাতে কিন্তু একবারও দেখিনি! এই মন্ট্রে কার্লে হচ্ছে মাফিয়াদের আস্তানা। এখানেই মাফিয়াদের সবচেয়ে বড় বড় লেনদেন হয়! মাফিয়া নামের একটি মেয়ের নামে গড়ে ওঠা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর এবং শক্তিশালী আন্ডারগ্রাইন্ড সন্ত্রাসী দলটি যে সারা পৃথিবীর পুলিশ প্রসাশনের ঘুম হারাম করে দেবে সেটা জানলে কি মাফিয়ার মা-বাবা এই নাম রাখতেন?

জেমস বন্ডের গোল্ডেন আই ছবির শুটিং হয়েছে এখানে। বিভিন্ন দেশের স্বল্প-বসনার পর্যটক দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি ছুটে চললো আরেক দেশ ইটালির উদ্দেশে। আমাদের এই ভ্রমণ ইটালির জেনোয়া হয়ে মিলান হয়ে সুইজারল্যান্ড জেনোভা হয়ে আবারো প্যারিস হয়ে লন্ডন। প্রায় ৪০০০ কিমি ভ্রমণ শেষ হয়েছিলো ৪ দিনে।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025