নিউজ ডেস্ক: প্রতিদিন তাঁদের জীবন কাটে রাজধানীর রাজপথে। জীবিকার টানে কেউবা সকাল-সন্ধ্যা খাটেন, কেউবা সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেন। ধাবমান এই ব্যস্ত জীবনে এবারের ঈদ কেমন কাটল তাঁদের, সেই অনুভূতির কথা জানিয়েছেন তাঁরা। এখানে তা সংক্ষেপে দেওয়া হলো:
মো. ইসমাইল – ছবি: মো. ইমরান আহম্মেদমো. ইসমাইল, ভ্যানচালক
‘এটা হলো ভাগ্যরে ভাই! কারও ঈদ কাটে সুখে, আবার কারও দুঃখে। ছোট দুই ছেলেমেয়েকে মাত্র ৫০০ টাকা করে দিয়েছি। এ তো একটা জুতা কেনার টাকাও না।’ এ কথা বলে খেদ ঝাড়েন রিকশা-ভ্যানচালক মো. ইসমাইল। মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের উত্তর পাশের ভ্যানের গ্যারেজের সামনে ছিলেন তিনি। পরিবারসহ রাজধানীর মুগদা এলাকায় থাকেন। দুই মেয়ে আর এক ছেলে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
ইসমাইল ও তাঁর স্ত্রী ঈদে কিছুই নেননি। সকাল থেকে ঘুমিয়েছেন। মনের দুঃখে নামাজ আদায় করতেও যাননি।
ঈদে বাসায় বিশেষ কিছু রান্না হয়নি। সকালে আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে পান্তা ভাত খেয়েছেন। দুপুরে যোগ হয়েছে পুঁইশাক।
সারা দিন সবাই বাসায় শুয়ে ছিলেন ইসমাইল। কারও বাসায় যাননি। তিনি বলেন, ‘কীভাবে যাব বলেন? আমরা কারও বাসায় গেলে যদি তাঁরা আমাদের বাসায় আসেন, কী খাইতে দেব। নিজের ছেলেমেয়েকেই দুইটা টাকা সালামি দিতে পারি না। অন্যের বাচ্চা আসলে কী দেব!’
আবুল বাশার ছবি : মো. ইমরান আহম্মেদআবুল বাসার, সিএনজি অটোরিকশাচালক
ঈদের দিন ফজরের নামাজ আদায়ের পর থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত সিএনজি অটোরিকশা চালিয়েছেন আবুল বাসার। এর মধ্যে কেবল সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর পান্থপথে রাস্তার ওপর ঈদের নামাজ আদায় করেছেন।
আবুল বাসারের গ্রামের বাড়ি খুলনার তেরখাদা উপজেলায়। দুই সন্তানসহ তাঁর স্ত্রী সেখানেই থাকেন।
ঈদ কেমন কাটালেন—জানতে চাইলে বাসার বলেন, ‘ঈদ বলতে আমি কিছু বুঝি না। সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। সারা বছর রাস্তায় জ্যাম থাকে। এদিন রাস্তা ছিল ফাঁকা। এটাই আমার ঈদ!’ আবুল বাসার থাকেন মিরপুর ১৩ নম্বরের এক মেসে। ঈদের দিন সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কিছুই খেতে পারেননি। বিকেলে এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেয়েছেন। ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদে নতুন পোশাক কিনতে কিছু টাকা পাঠিয়েছেন। তবে নিজের জন্য কিছুই কেনেননি। তাঁর মতে, পৃথিবীতে যত দিন ধনী-গরিবের ব্যবধান থাকবে, তত দিন সবার জন্য ঈদ কখনোই হবে না।
কাজী নজরুল ইসলাম-ছবি : মো. ইমরান আহম্মেদকাজী নজরুল ইসলাম, রিকশাচালক
এবার ঈদে রিকশা চালাননি কাজী নজরুল ইসলাম। সারা দিন স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে বাসায় কাটিয়েছেন। প্রায় ১০ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান নজরুল। দুই মেয়ে আর দুই ছেলে নিয়ে ঢাকার মানিকনগর এলাকায় থাকেন তিনি।
ঈদ উপলক্ষে বাসার সবার জন্য নতুন পোশাক কিনেছেন। নিজের জন্য একটি পাঞ্জাবি আর একটি লুঙ্গি নিয়েছেন। ঈদের দিন বাসায় খিচুড়ি, মাংস আর সেমাই রান্না করা হয়েছে। সবাই মিলে মজা করে খেয়েছেন।
নজরুলের বড় ছেলে ও মেয়ে চাকরি করায় সচরাচর সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করার সময় হয় না। এদিন সবাই ছুটি পাওয়ায় সবাই গল্প করে কাটিয়েছেন। কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন কি না—জানতে চাইলে নজরুল বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমাদের আর বেড়াইতে যাওয়া!’
মো. মাসুম – ছবি : মো. ইমরান আহম্মেদমো. মাসুম, বাসচালকের সহকারী
ঈদের দিন সকালে নামাজ আদায় করে ১০টার দিকে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন মাসুম। রাত ১০টা পর্যন্ত গাড়িতেই ছিলেন তিনি। অন্য দিনের মতো এভাবে ব্যস্তার মধ্যে কেটেছে তাঁর ঈদের দিন। কীভাবে দিনটা যে পার হয়ে গেল, তা তিনি টেরই পাননি। ঈদ উদযাপনের কথা এভাবেই বর্ণনা করেন বাসচালকের সহকারী মাসুম। মতিঝিল থেকে চিড়িয়াখানা রোডের নিউভিশন গাড়ির চালকের সহকারী তিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। দুই সন্তানসহ স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তিনি থাকেন ঢাকার গাবতলী এলাকায়।
স্ত্রী-সন্তানদের জন্য নতুন পোশাক কিনতে টাকা পাঠিয়েছেন। নিজের জন্য একটি জিনসের প্যান্ট আর শার্ট কিনেছেন। ঈদ কাটানোর অনুভূতি জানাতে মাসুম বলেন, ‘বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান রাইখা একা থাকতে অনেক খারাপ লাগে। ভাই, মালিকের গাড়ি চালাই। ঈদের দিনও গাড়ি চালান লাগে। কী করমু কন?’ তাঁর কাছে ঈদের দিন আর অন্য দিনের তেমন তফাত নেই। দোকানপাট বন্ধ থাকায় ঈদের দিন দুপুরে ঠিকমতো খেতে পারেননি। রাতের বেলা অন্যান্য দিনের মতো দুমুঠো খেয়ে ঘুমিয়েছেন।
মো. আকরাম হোসেন -ছবি : মো. ইমরান আহম্মেদমো. আকরাম হোসেন, ট্রাফিক পুলিশ
ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করেছেন মো. আকরাম হোসেন। তারপর বাসায় গিয়ে ঈদের বিশেষ খাবার পোলা-মাংস খেয়েছেন। দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা চলে এসেছেন দায়িত্ব পালন করতে। দায়িত্বটা ট্রাফিক পুলিশের। তাই রাস্তায় সটান খাড়া থেকে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। বেলা দুইটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শাহবাগের মোড়ে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ঈদ উপলক্ষে স্ত্রী-সন্তানদের কোনো সময় দিতে পারেননি। তাঁরা ঘুরে নিয়ে যাওয়ার দাবি করলেও তিনি সময় দিতে পারেননি। এর পরও ঈদ নিয়ে খুশি আকরাম। প্রতিবছরের তুলনায় এবার ভালোভাবেই পথচারীদের পারাপার করতে পেরেছেন বলে তাঁর দাবি। ঈদের পর থেকে এখনো ছুটি পাননি আকরাম। তবু ঈদ উদযাপন নিয়ে তাঁর কোনো খেদ নেই। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যা করতে দিয়েছেন, তাতেই খুশিরে ভাই!’