সূত্র জানায়, শুধু নিজের কারণেই নয়, পরিবারের সদ্যদের কর্মকান্ডের কারণেও বিতর্কিত হয়েছেন অনেক রাষ্ট্রদূত। বারবার সতর্ক করেও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত রাখতে পারছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শেষমেষ দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে।
এমন বিতর্কিতদের তালিকায় সর্বশেষ যোগ হলেন গোলাম মোহাম্মদ। নিজ বাসায় নিমন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক নারীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি গ্রিসের আইওএম মিশনপ্রধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়ায়। তৎপর হয়ে মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল দেশটিতে পাঠায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম ইউনিটের প্রধান ও মন্ত্রণালয়ের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল গত ১১ আগস্ট এথেন্সে গিয়ে তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর তদন্ত করেন। সেই তদন্তদলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই তাকে দেশে ফেরত আসার ফরমান পাঠানো হয়েছে।
এর আগে ২০১১ সালে জাপানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত একেএম মজিবুর রহমানকেও একইভাবে দেশে ফেরত আনা হয়। টোকিও মিশনে কর্মরত এক জাপানি নারীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। উজবেকিস্তানে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হাসিব আজিজ রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া বিদেশি এক নারীকে বিয়ে করায় তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।
চলতি বছরেই মিশন পরিচালনায় ব্যর্থতা ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণের অভিযোগে চলতি বছরের জুলাই মাসে লেবাননে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ এফ এম গওসুল আযম সরকারকে দেশে ফিরিয়ে আনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে সূত্র জানায়, তার স্ত্রীর নানা বিতর্কিত কর্মকান্ড দূতাবাসের গন্ডি পেরিয়ে লেবানিজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছায়। লেবানন সরকার তাকে দেশ ছাড়ার আল্টিমেটামও দেয়।
অভিযোগ ওঠে গাউসুল আযমের স্ত্রী দূতাবাসের কর্মচারিদের উপর প্রভাব ফেলতেন। এমনকি দূতাবাসের কাউন্সেলর মনিমুল হকের স্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। একজন বাংলাদেশি শ্রমিককে আটকে রেখে অর্থ আদায়ের অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।
সাবেক সচিব মিজারুল কায়েস সচিব থাকাকালীন বিতর্কিত হন। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে তার নিজের যেমন, তেম্নি তার স্ত্রীর কর্মকান্ড নিয়েও সম্প্রতি নজিরবিহীন কাণ্ড ঘটে গেছে। ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েছেন মিজারুল কায়েস। তার স্ত্রী নাঈমা চৌধুরি কায়েস পরিচালিত দাতব্য সংস্থা এইজিং ওয়েল ইউকে লিমিটেডের নামে তহবিল সংগ্রহ এবং তা ব্যয়ের হিসাব নিয়ে বির্তক ওঠে। হাইকমিশনের ঠিকানা ব্যবহার করে তার স্ত্রীর বেসরকারী সংস্থা পরিচালনা করা এবং বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করলেও তা দেশে না পাঠানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, এইজিং ওয়েল বাংলাদেশের এইজ ওয়েলের একটি শাখা, যে প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত। তবে এইজ ওয়েলের ঢাকা অফিসের কর্মকর্তারা লন্ডনের এইজিং ওয়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনও সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। সেইসঙ্গে নাঈমা চৌধুরি কায়েসের কাছ থেকে কোনও তহবিল তারা পাননি বলেও কর্মকর্তারা জানান। এর আগে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসও অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে বিতর্কিত হন। তার নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে তাকে লন্ডন থেকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ এবং নতুন চালু হওয়া ব্রাজিল দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কূটনৈতিক সূত্র জানায়, একজন রাষ্ট্রদূত বিদেশে নিজ দেশ ও সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার যে কোনো ধরনের অনিয়ম বা অভিযোগ দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের দৈনন্দিন কাজকর্মও ব্যাহত হয়। এছাড়া তদন্ত কমিটি পাঠানোসহ নানা প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তাদের মূল্যবান সময়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রের মোটা অঙ্কের অর্থও অপচয় হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এসকল তদন্ত কমিটির প্রতিটিতে প্রতিটি তদন্ত কমিটিতে কমপক্ষে তিনজন করে কর্মকর্তা থাকেন। মোটা টাকা খরচ করেই তাদেরকে তদন্তে পাঠাতে হয়।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, রাষ্ট্রদূতদের কাজ দেশের ভাবমূর্তি বাড়ানো। মিশন চালাতে সরকারের ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আয় বাড়ানো। কিন্তু সেসব না করে তারা ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষা ও নানা অপকর্মের কারণে বিতর্কিত হয়ে দেশের বোঝা হয়ে উঠছেন। এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রিস, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন। রাষ্ট্রদূতদের কুকীর্তি তাদের জীবনেও প্রভাব ফেলে। কারণ, সংশ্লিষ্ট দেশে তারা ভাবমূর্তি সংকটে ভোগে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপাক্ষিক) মুস্তাফা কামাল বাংলানিউজকে বলেন, কূটনীতিকদের বিতর্কিত হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু এসব ভাবমূর্তি নষ্টকারী কূটনীতিকদের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবসময়ের মতই কঠোর। নিয়ম অনুযায়ীই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।