মাঈনুল ইসলাম নাসিম: মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না ?
গভীর আবেগের এই কথামালাও কখনো কখনো শুধু কথার কথাই হয়ে থাকে যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জব ডেসক্রিপশনের অপর নাম হয় দায়িত্বহীনতা। তার সাথে যদি যোগ হয় উদাসীনতা, সেই সাথে দায়িত্বশীলতার পরিবর্তে যদি বিপদগ্রস্ত কারো মাথায় কাঠাঁল ভেঙ্গে খাওয়ার আয়োজন করা হয়, তাহলে তো কথাই নেই।
গলা থেকে পা, প্রায় পুরো শরীর প্যারলাইজড হওয়া মৃত্যুপথযাত্রী অসহায় বাংলাদেশী ইমরান হোসাইনকে ঘিরে দক্ষিণ কোরিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস গত ৩ বছর তার চাইতেও বেশি দায়িত্বহীনতা আর উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। স্বয়ং রাষ্ট্রদূতেরই নাকি এতোকিছু জানার এবং শোনার টাইম ছিল না।
অনলাইনে ‘ভারইরাল’ হওয়া ইমরানের সাথে দূতাবাসের লেবার উইংয়ের ‘অস্বাভাবিক প্রভাবশালী’ কমিশন মাস্টার নিজামুল হকের সর্বশেষ কমিশন-ফোনালাপ থেকে দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে ২০১২-১৫ রাষ্ট্রদূত সহ দূতাবাস কর্মকর্তাদের টাইম না থাকা সহ বেশ কিছু অপ্রিয় সত্য।
কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে আলাপ করার পাশাপাশি বিভিন্ন মহলে ক্রস-চেক করে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, ২০১২ সালের জুলাই থেকে আজ অবধি এখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনভাবেই দায় এড়াতে পারেন না ইমরান ইস্যূতে। ৩ বছর আগে সংমো হাসপাতাল কর্তৃক ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে স্পাইনাল কর্ড ড্যামেজ জনিত প্যারালাইজড হওয়ার পর আইন তার আপন গতিতে চলেনি শুধুমাত্র দূতাবাসের উদাসীনতার কারণে।
লেবার উইং থাকা সত্তেও দূতাবাসের দায়িত্বহীনতার সূচনা হয় যখন কর্মস্থলে দুর্ঘটনা জনিত ইনস্যুরেন্স কোম্পানি কর্তৃক চরম অন্যায়ভাবে প্রত্যাখাত হয়েছিল ইমরান। এক বছর সুস্থ শরীর নিয়ে কোম্পানিতে ‘মালিকের মন জয়’ করার পর চরম দুঃসময়ে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ইমরানেকে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ থেকেই নাকি ‘ইনজুরি’ নিয়ে এসেছিল ইমরান।
দূতাবাসের লেবার উইং তখন কিছুই করেনি ‘ভিক্টিম বাংলাদেশী’ ইমরানের জন্য। কাউন্সিলর বা রাষ্ট্রদূতের টাইম ছিল না তখন স্বদেশীর স্বার্থ রক্ষায়। ভুল আপরেশনের ৪ মাসের মাথায় যখন কুখ্যাত সংমো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কসাই ডাক্তারকে বাঁচাতে ইমরানকে ‘বাই-ফোর্স’ অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করে, তখনও সিউলের বাংলাদেশ দূতাবাস ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
দূতাবাসের ঘুম না ভাঙ্গলেও ইমরানের অপারেশনের আগে থেকেই সবকিছু জানতো লেবার উইংয়ের ‘কমিশন ব্রোকার’ নিজামুল হক। নতুন হাসপাতালের ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন নিশ্চিত হন ইমরান সংমো হসপিটাল কর্তৃক রং ট্রিটমেন্টের শিকার, তখনও সময়মতো ঘুম ভাঙ্গেনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের কষ্টার্জিত অর্থে পরিচালিত বাংলাদেশ দূতাবাসের।
সুচতুর নিজাম তার পছন্দমাফিক উকিলকে নিয়োগ দেয় ইমরানের হয়ে মামলা পরিচালনার জন্য। চুক্তি ছিল লেবার ইনস্যুরেন্স এবং সংমো হসপিটাল উভয়ের বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলা হবে। কিন্তু টানা ২ বছরের বেশি পার হলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ‘ক্রিমিনাল মামলা’ করা দূরের কথা, সামান্য ক্ষতিপূরণের ‘ক্লেইম’ করে দিনে-দুপুরে ঠকানো হয় ইমরানকে।
হাসপাতালের বিরুদ্ধে ‘ক্রিমিনাল মামলা’ না করে ইমরানকে ব্ল্যাকমেইল করা হলেও দূতাবাস ছিল যথারীতি নিরব। নিম্ন আদালতে দায়ের করা তথাকথিত মামলার রায় ইমরানের অনুকুলে এলে উকিল নেবে ২০% আর দূতাবাসের নিজামুল হক নেবে ২%, এমনটাই পাকপাকি হয় শুরুতে। তবে উকিলের কাছ থেকে কত পার্সেন্ট নেবে নিজাম, তা গোপন রাখা হয় কঠোরভাবে।
সম্প্রতি নিম্ন আদালতের রায় ইমরানের বিপক্ষে যাবার পর ঐ একই পাতানো উকিল দিয়ে আপিল তামাশার পর্বটিও সেরে নেয় প্রতারক নিজাম। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, নিম্ন আদালতে মামলা চলাকালীন সময়েই প্রভাবশালী সংমো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘ম্যানেজ’ করে নেয় নিজামের ভাড়া করা উকিলকে।
ইমরানকে ঘিরে নিজামের পজিশন এতোটাই সুবিধাজনক ছিলো যে, মামলায় জিতলে ইমরানের কাছ থেকে টু পার্সেন্টের পাশাপাশি উকিলের কাছ থেকেও পেতো বিশেষ কমিশন। উকিলের কাছ থেকে নিজামের কমিশন শুধু মামলা জেতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল না, মামলায় হেরে গেলেও উকিলের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ পাবে নিজাম, এমন গোপন সমঝোতাই হয় তাদের মধ্যে।
নিম্ন আদালতে ‘ফেব্রিকেটেড’ রায় হবার পর ইমরান উকিল পরিবর্তন করতে চাইলে নিজাম সহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাঁকে বোঝান যে, উকিল পরিবর্তন করলে খরচা বাবদ বিপুল অংকের অর্থ উকিলকে পরিশোধ করতে হবে। উকিলকে দিয়েও কৌশলে এমনটা জানিয়ে দেয়া হয় বর্তমান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।
ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আপীল পরবর্তী মামলায় চূড়ান্তভাবে হেরে যাবার পর নিজামের এই পাতানো উকিলের যাবতীয় খরচাদি কে বা কারা বহন করবে, ইমরানের এই যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারেননি, সবকিছু পানির মতো ক্লিয়ার হওয়া সত্তেও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথা বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না, সিউলের এমন অনেকেই এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের চরম গাফিলতির সুযোগে সংমো হাসপাতালের সাথে উকিলের গোপন সমঝোতা হয়েছে ইমরানকে মামলায় এমনকি আপিলেও হারিয়ে দেয়ার জন্য। টোটাল এই মেকানিজমের মধ্যে দূতাবাসের নিজাম শক্তভাবে থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে উকিলকে ধরে রেখে অসহায় ইমরানের মাথায় কাঠাঁল ভেঙ্গে খেতে। ফলে বিচারের বানী কেঁদেছে নিরবে নিভৃতে।
জুলাই-টু-জুলাই ২০১২ থেকে ২০১৫ ইমরান ইস্যুতে সিউলের বাংলাদেশ দূতাবাস যেভাবে কলংকিত হয়েছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ ‘ভাইরাল’ হওয়া সর্বশেষ ফোনালাপ। খোদ রাষ্ট্রদূতকেও থোড়াই কেয়ার করতে কার্পন্য করেনি দূতাবাসের কমিশন বানিজ্যের এই নিয়ন্ত্রক। ‘রাষ্ট্রদূতের শোনার টাইম নাই’ এমন কথা পরিষ্কার করেই বলেছে নিজাম। প্রতারনার অভিযোগে যেখানে উকিলের বিরুদ্ধেই মামলা করার ‘লজিক্যাল রাইট’ রয়েছে ইমরানের, সেখানে তা না করে উল্টো নিজামের নিয়োগ দেয়া পাতানো উকিল দিয়েই আপীল পরিচালনার সিদ্ধান্তের কারণে নিশ্চিত করুন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে বহুল আলোচিত ইমরান ট্র্যাজেডি।
কয়েক মাস আগে দায়িত্ব গ্রহনকারী বিজ্ঞ রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান তাঁর নিজ গুণে ইমরানের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন, এই আশাবাদ সিউলের সচেতন বাংলাদেশীদের। আগেকার রাষ্ট্রদূতের টাইম না থাকার কথা শুনতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে:
[youtube id=”YNosd6MacKg” width=”600″ height=”350″]